চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪

পারিবারিক সহিংসতার কারণ ও প্রতিকার

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

২৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:২৪ পূর্বাহ্ণ

সহিংসতা (ারড়ষবহপব) অর্থ হিংসাযুক্ত আচরণ। হিংসার বশবর্তী হয়ে একে অপরের প্রতি যে আচরণ করে তাই সহিংস আচরণ বা সহিংসতা। পরিবারের এক সদস্য কর্তৃক অপর সদস্য সহিংস আচরণ তথা অত্যাচার, অবিচার ও নির্যাতনের শিকার হওয়া মানে পারিবারিক সহিংসতা। যেমন পিতা-মাতা বা তাদের একজন কর্তৃক ছেলে-মেয়ের প্রতি সহিংসতা অথবা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর প্রতি সহিংসতা অথবা স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর প্রতি সহিংস আচরণ। পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে, যেমন রক্ত সম্পর্কীয়, বৈবাহিক সম্পর্কীয়, দত্তক বা যৌথ পরিবারের সদস্য এমন কোন ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অপর কোন নারী বা শিশু সদস্যের ওপর শারীরিক, মানসিক, যৌননির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতি সাধনকেও পারিবারিক সহিংসতা বুঝায়। পরিবারের বড়জন বা শক্তিশালী ব্যক্তি কর্তৃক শিশু বা ছোটজন তথা দুর্বল ব্যক্তি অত্যাচারের শিকার হওয়া পারিবারিক সহিংসতার অন্তর্ভুক্ত। পরিবারভুক্ত নয় বা অনাত্মীয়, কিন্তু সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক আছে- এমন ব্যক্তি কর্তৃকও পরিবারের সদস্য শারীরিক, মানসিক, আর্থিক সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। মান-সম্মানে আঘাত করাও সহিংস আচরণের মধ্যে পড়ে।

সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, দাম্পত্য কলহ, অর্থলিপ্সা, মাদকাসক্তি, অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক, পরকীয়া ইত্যাদির জের ধরে বর্তমানে সহিংসতা, হত্যা, আত্মহত্যা, ইত্যাদি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। স্বামী স্ত্রীকে অথবা স্ত্রী স্বামীকে খুন করছে। পারিবারিক সহিংসতার কারণে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথকে বেছে নিচ্ছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী কানাডার মত উন্নত দেশে ২০১০ সাল হতে ২০১৫ সালের মধ্যে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে ৪৭৬জন মৃত্যু বরণ করেছে (প্রবাসী কন্ঠ, ৭ জানুয়ারী, ২০১৯)।
কানাডার পারিবারিক সহিংসতার সংখ্যার বিবেচনায় তৃতীয় বিশ্বের সংখ্যা সহজে অনুমেয়। এক জরীপে বাংলাদেশে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পারিবারিক সহিংসতায় মারা যায় ৩২ জন। এ ছাড়া সামাজিক সহিংসতায় ৪৮ জন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ২৯ জন, চিকিৎসকের অবহেলায় ৯ জন মারা গেছে। অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে ১১ জনকে, গুপ্ত হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে, রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ৫৫ জনের এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫ জনকে। পরিবহন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৫৮ জনের। আত্মতহ্যা করেছে ১৯ জন। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩ জন (যায়যায় দিন, ২ অক্টোবর, ২০১৯)। উল্লেখিত সংখ্যক মানুষের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু।

বাংলাদেশে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। উক্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সে আইন সফলতার তেমন মুখ দেখেনি। তাই ৩৯টি মানবাধিকার সংগঠনের উদ্যোগে গঠিত হয় পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ নাগরিক জোট। তাদের দাবি ও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ১২ অক্টোরবর পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০ প্রণয়ন করা হয় (ইত্তিফাক, ১২ নভেম্বর, ২০১৪)। বাস্তবতা হলো, এত আইন প্রণয়ন ও চেষ্টার পরও পারিবারিক সহিংসতা কমেনি, বরং আগের তুলনায় বেড়ে গেছে গাণিতিক হারে। ফলে সচেতন জনগণের মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছে পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে। সমাজ বিজ্ঞানীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন সমাধান দিতে। বলতে গেলে, এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইন ব্যর্থ হয়েছে, যদিও আর্থ-সামাজিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের উন্নয়নসূচক ঊর্ধমুখী। এমন বাস্তবতায় পারিবারিক সহিংসতা রোধে নৈতিক শিক্ষার অভাবকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। এটা বাস্তবও বটে। যথাযথ নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ ও বাস্তব জীবনের তার অনুশীলনে ফিরে যাওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। আর সেই নৈতিক শিক্ষা শুরু হতে হবে পরিবার থেকে, যদিও প্রাতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষাকে উপেক্ষা করা যায় না। কারণ, পরিবারের বড়জনদের থেকেই সাধারণত শিশুরা বিভিন্ন আচরণ রপ্ত করে। তারা সাধারণত অনুকরণপ্রিয় হয়ে থাকে। যা দেখে বা শুনে সেগুলোর প্রভাব পড়ে তাদের পরবর্তী জীবনে।

স্থান, কাল, পাত্র, অবস্থা ভেদে পারিবারিক সহিংসাতার অনেক কারণ আছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের পৃথক পৃথক কারণও আছে। পারিবারিক সহিংসতার কিছু সাধারণ কারণ হলো, যেমন, বিদ্যাহীনতা, সুশিক্ষার অভাব, দারিদ্র, লোভ-লালসা, অসম প্রতিযোগিতা, অলসতা, মাদকাসক্তি, অহংকার, শক্তি প্রদর্শনের মানসিকতা, অসংযমী মেজাজ, দায়িত্বহীনতা, নিজ দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া, সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব, রাষ্ট্রীয় আইনের দুর্বলতা ও প্রয়োগের অভাব বা অপপ্রয়োগ, বিদেশী সংস্কৃতির অনুসরণ, নৈতিক জীবনাচারকে গুরুত্ব না দেয়া ইত্যাদি। নারীর প্রতি সহিংসতার কারণগুলো হলো, যৌতুকপ্রথা, আর্থিক সমস্যা, মানসিকতার পরিবর্তন, যুদ্ধের প্রভাব, নৈতিকতার অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, অদক্ষ গৃহকর্মী, শিশুগৃহকর্মী, নিজের পছন্দের বিয়ে, নিজেকে স্ত্রীর প্রভু মনে করা, নারীসমাজকে অবজ্ঞার চোখে দেখা, স্বামীর আর্থিক বা সামাজিক দুর্বলতার কারণে তাকে অবজ্ঞা করা ইত্যাদি। (চলবে)

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট