চট্টগ্রাম রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪

স্মৃতিতে মনীষী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

২৪ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:০০ পূর্বাহ্ণ

কোন বিশেষণে তাকে বিশেষিত করি? শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, রাজনীতিক! আজকাল এসব অভিধা অনেকের বেলায় ব্যবহৃত হয়। কিন্তু তার অবদান ও ব্যক্তিত্ব তো আরো বিশাল বিস্তৃত। এজন্য আমি বলেছি ‘মনীষী’। মনীষী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এ যুগের এক আদর্শ পন্ডিত। মুখে ছাটা দাঁড়ি, মাথায় টুপি, পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী, শীতের মৌসুমে অতিরিক্ত শেরোয়ানী-মাফলার। এটা তার নিত্য দিনের মুসলমানী পোষাক। কিন্তু শ্রীরাম কৃষ্ণের কিম্বা বিবেকানন্দের জম্মদিনে তাকে সভাপতি বা প্রধান অতিথি হিসেবে ডাকলে সেখানে যেতে তার মুখে না উচ্চারিত হতো না, বৌদ্ধ পূর্ণিমার অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যেতেও তার অনীহা নেই। যেখানে গিয়েছেন তার বক্তৃতা যেন সেরা। বলে গেছেন অর্নগল, স্বাচ্ছন্দ্যে! শুধু কি বক্তৃতা? তারই সাথে কবিতা আবৃত্তি! আর তাও শুধু রবি ঠাকুর, নজরুল, জসিম, ফররুখ , মদুসূদন নয়, সাদী, হাফিজ, রুমি, ইকবাল, গালিব, বিদ্যাপতি, চন্ডিদাশ। গদ্য, গল্প, উপন্যাসেও তার উদ্ধৃতি প্রদানের জুড়ি নেই।

টলস্টয়, রমারলা, ডিকেন্স, হেমিংওয়ে, বঙ্কিম সবার ভুবনে তার পদচারণা! বক্তৃতাতে তিনি বিদেশীদের বাণী উদ্ধৃতি করতেন বিদেশী ভাষায়। তার আলোচনা ছিল যেন চাকভরা মধু নাড়া খেয়ে ঝড়ে পড়েছে। গত সপ্তাহে তার স্মরণে ও শ্রদ্ধায় একটি লেখার সূচনা করেছিলাম। বলেছিলাম, দৈনিক পূর্বকোণের জন্য সাক্ষাতকার নেয়ার জন্য তার রামপুরাস্থ বাসায় যাই। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে এত বই-পুস্তকের ছড়াছড়ি দেখলাম যে, মনে হয়েছে শুধু শোবার বা বিশ্রামের জায়গাটুকুন ছাড়া সবখানেই বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন, পত্র-পত্রিকা। বইয়ের ভারে বুক সেল্ফটি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। সেদিন অবশ্য আমি তার কোন ছবি উঠাইনি। তিনি নিজে আমাকে তার দু’কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি দিয়েছিলেন। সেদিনকার তার পড়ার কক্ষে আমার সুখ-স্মৃতির সাথে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র সাক্ষাৎকারে রুমটির বেশ মিল খুঁজে পেয়েছি যা আজো আমি মাঝেমধ্যে ছবি সংক্রান্ত ফাইল খুললে এক নজর দেখি। পত্রিকাটির নাম (অধুনালুপ্ত) ডায়লগ/সংলাপ, ঢাকা, ১৩ জুলাই’ ৯০। দেওয়ান আজরফ সেদিন পূর্বকোণের জন্য নিজ হাতে স্মৃতিচারণমূলক লেখা লেখেন এবং এতে চট্টগ্রাম সম্পর্কে বহু ঐতিহ্য বর্ণনা দেন। যা দৈনিক পূর্বকোণে ১০ জানুয়ারী ১৯৯১ সালে ‘বিনোদন-১৪’ এ ‘ চট্টগ্রামে প্রথম যেদিন- দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এতে তিনি বলেছেন: ছেলে বেলা থেকেই চট্টগ্রামের নাম শুনতাম। আমাদের বড় ভাই চট্টগ্রাম থেকে একটি বড় সড় রাতা (মোরগ) সংগ্রহ করে আনেন। এর মাথায় সামান্য পালক থাকলেও গলা ছিল একেবারেই খালি। দেখতে অনেকটা উটের প্রতিচ্ছবি মনে হয়। এটির তেজ ছিল খুব বেশী। আমাদের দেশী (সিলটি) রাতাদের সাথে লড়াইয়ে প্রায়ই জয়ী হত। এহেন রাতার দেশকে দেখার জন্য মনে উৎসাহ দেখা দেয়। তার কিছুদিন পর একটি বোচকায় করে কিছু বিস্কুট নিয়ে আমাদের বাড়ীতে এলেন এক আত্নীয়। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বললেন: এগুলো চাটগাঁইয়া বিস্কুট, খাইতে খুব ভাল। আমাদের বাড়িতে তখন হান্টলি ফার্মাস বিস্কুটের খুব প্রচলন ছিল। নতুন বিস্কুটের স্বাদে মনে হলো বিলেতি বিস্কুট থেকে চট্টগ্রাম দেশীয় বিস্কুটের মান খাটো নয়।

শৈশবে যে দেশের মোরগের শারীরিক ব্যতিক্রম দেখি, কৈশোরে যে দেশের বিস্কুটের পেয়েছিলাম অপূর্ব স্বাদ, যৌবনের সূচনায় তাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের ইতিহাস পাঠের জন্য মনে বিশেষ আগ্রহ জম্মে। তখন এক পাক্ষিক পত্রিকায় চট্টগ্রামের ইতিহাস পাঠের সুযোগ পাই। তবে উক্ত বইয়ে চট্টগ্রামের অতীত গৌরবের প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল: এটা হচ্ছে বারো আউলিয়ার মুলুক।’ এতে আমার কাছে চট্টগ্রামে মান খুব উন্নত বলে মনে হয়নি। কেননা আমি সিলেটের মানুষ। এ সিলেটকে বলা হয় তিনশ ষাট আউলিয়ার দেশ.. ..।’ একটু পরেই তিনি বলেছেন: ১৯৫৭ সালের দিকে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে যাওয়ার সুযোগ হয় কবি গোলাম মুস্তাফাদের সাথে, এক সাহিত্য সম্মেলনে, স্থান ছিল যাত্রামোহন হল।

সাধারণত: সম্মেলন ও অধিবেশন হত বিকেলের দিকে। এজন্য সকাল ও সন্ধ্যার পর বেশ অবসর পাওয়া যেত। আমরা স্বেচ্চাসেবকদের নিয়ে চাটগাঁর দ্রষ্টব্য স্থানগুলো দেখার জন্য সকাল-সন্ধ্যা বেরিয়ে পড়তাম। চাটগাঁয়ে আমার কাছে দ্রষ্টব্য স্থান হিসেবে যেগুলো ছিল প্রধান, তন্মধ্যে রয়েছে হযরত বায়েজীদ বোস্তামীর খানেকাহ, শেখ ফরিদের চশমা, শাহ আমানত (রহ.)এর মাজার। প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে কবি নবীন চন্দ্র সেনের স্মৃতি বিজড়িত কর্ণফুলী নদী এবং সে সমুদ্দুর উপকূলে অবস্থিত ডবলমুরিং এর দৃশ্য। এছাড়া চাটগাঁয়ের পাহাড়তলীর দৃশ্যবলীর অনেক কথাও আমরা পূর্বে অনেক দর্শকের কাছে শুনেছিলাম। সেগুলোর গম্ভীর অবস্থান বাস্তবিকই ছিল আমার কাছে অপূর্ব…।’ তার ভাষায়: চট্টগ্রামের দৃশ্যাবলী, নাগরিকদের খানাপিনা আর আচার-ব্যবহারের সাথে আমাদের সিলেটের পরিবেশ ও জীবন যাত্রার মধ্যে অদ্ভূদ মিল দেখা যায়। ১৮৩১ সালে ইংরেজ ও শিখদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের সময় এবং পরবর্তীতে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় উভয় জেলার লোকই ছিল সমচিন্তায় উদ্ভাসিত.. ..। জীবন সায়াহ্নে স্বপ্ননগরী চট্টগ্রামের উক্ত প্রেক্ষাপট, দৃশ্যপট ও স্মৃতিমালা ভেসে ভেসে উঠছে আমার আঁখি যুগল ও হৃদয়পুরে।’ সেদিন বয়োবৃদ্ধ মনীষী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের উপরোক্ত কথামালা সংগ্রহের পর তার বাসায় আপ্যায়ন করি। বিদায় বেলায় বিনিতভাবে বললাম, আমাকে দোয়া করুন। তিনি কলম নিয়ে আলাদা কাগজে লিখেছিলেন: মনীর-উল-ইসলাম রফিক- মরদ্-ই-মুমিন হও…।’- এ মূল্যবান দোয়া ও বাণী সম্বলিত কাগজটি আমি আজো সংরক্ষণ করে রেখেছি। আজ তিনি নেই, স্থান নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়।

মরহুম দেওয়ান আজরফের জম্ম: ১৯০৬ সালে ২৫ অক্টোবর নানা মরমী সাধক হাসন রাজার সুনামগঞ্জস্থ তেখরিয়া পাড়ার বাড়িতে। ইন্তেকাল করেন নভেম্বর মাসের পহেলা তারিখ ঢাকায়। আমরা তার মাগফিরাত ও রা’ফি দারাজাতের জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করি।

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট