চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ: বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখতার আহমদ

মো. খোরশেদ আলম

২১ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:০৩ পূর্বাহ্ণ

আজ ’৬০এর দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখতার আহমদ এর ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাঁশখালী সাধনপুর ইউনিয়নের রাতাখোর্দ্দ মোজাফফরাবাদ অজপাড়া গায়ে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে এই বীরের জন্ম। পিতা আবদুল আলী সওদাগর, মাতা মাইমুনা খাতুন। ৪ ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৪র্থ। স্কুলজীবনে একজন দক্ষ ফুটবলার ছিলেন মোখতার আহমদ। ২০০৬ সালের ২১ অক্টোবর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন এই মহান নেতা।

রাজনীতিতে তাঁর পদার্পণ ১৯৬২ সালে কুখ্যাত হামিদুুর রহমানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সেই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত অগ্রণী বাহিনীর গোপন সংগঠন (নিউক্লিয়ার্স) চট্টগ্রামের তিনি সদস্য নির্বাচিত হন। সেই সংগঠনের প্রধান ছিলেন আবদু রাজ্জাক। ’৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে রাজ্জাকভাই বাকশালের নেতৃত্ব দেন। মোখতার আহমদ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সরকারী কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি।

১৯৬৭-৬৯ সালে মোখতার আহমদ অবিভক্ত বৃহত্তর চট্টগ্রামের জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সেই সময় তার সাথে সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন ছিলেন চট্টগ্রামের আরেক রাজনৈতিক প্রবাদপুরুষ এসএম ইউছুফ। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলার আহবায়ক। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে মোখতার আহমদ সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েন। সেই সময় আওয়ামী সেচ্ছাসেবক বাহিনীর কেন্দ্রীয় প্রধান ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। মোখতার আহমদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পান। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই ঘোষণা শোনার পর তিনি চট্টগ্রামে এসে ছাত্রজনতাকে সাথে নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ১নং সেক্টর কর্তৃক তিনি বাঁশখালী, আনোয়ারা ও কুতুবদিয়ার থানার আঞ্চলিক অধিনায়ক নিযুক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে পরাস্ত করেন।

’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তার উপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ছিল। ১৯৮২ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ১৫ দলীয় জোটের একটি গোপন বৈঠক থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৮৬ সালে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি চট্টগ্রামের আরেক কিংবদন্তি নেতা দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগ এর সভাপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সাথে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাবন্দী ছিলেন। ১৯৮৮ সালে আনোয়ারা পশ্চিম পটিয়া আসনে জাসদ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে জামাত-বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার পুনরায় ক্ষমতায় এলে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের উপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন ও জুলুম অত্যাচার। পুলিশের বাঁধার কারণে কোথাও মিছিল মিটিং করার সুযোগ ছিলনা। মোখতার আহমদ সেই সময় নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ২০০২ সালে জুলাই মাসের মাঝামাঝি তিনি আমাকে তাঁর বাসায় দেখা করতে খবর দিলে পরের দিন সন্ধ্যায় আমি সেখানে যাই। গিয়ে দেখি আগে থেকে সেখানে বখতেয়ার নুর সিদ্দিকী, আব্দুল্লাহ কবির লিটন, আবু সৈয়দ, রণতোষ দাশ, নুরুল আলম, মৌলভী নুর হোসেনসহ অনেকেই উপস্থিত।

মোখতার ভাই চট্টগ্রাম শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা পরিষদ, বৈশাখী মেলা, একুশে মেলা, চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক সমন্বয় পরিষদের উপদেষ্টা এবং স্বাধীনতা মেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। সকল লোভ-লালসার উর্দ্ধে ছিলেন তিনি। রাজনীতি যে মাটি ও মানুষের জন্য এবং দেশের জন্য মোখতার আহমদ তার জ¦লন্ত প্রমাণ। অথচ আর্থিক অনটনের কারণে মোখতার আহমদের সু-চিকিৎসা হয়নি। মোখতার ভাইয়ের মত সৎ ও যোগ্য নেতার আজ বড়ই অভাব। এরশাদ সরকারের আমলে এমপি থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম শহরে কোথাও তাঁর একখন্ড জমি নেই। পৈত্রিক ভিটেমাটি সবকিছু নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলে ঐসময় অবৈধভাবে প্রচুর অর্থ সম্পদ অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু অবৈধ অর্জন, অর্থের মোহ, লোভ লালসা কোনটাই তাকে নীতি, আদর্শচ্যুত করতে পারেনি।

এই ক্ষণজন্মা বীরের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি এবং আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন। আমিন।

মো. খোরশেদ আলম শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট