চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সুফল পেতে চাই প্রকৃতিনির্ভর পরিকল্পনা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা

১৮ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৫৯ পূর্বাহ্ণ

প্রজনন মৌসুমের কারণে ৯ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে ইলিশের আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, বেচাকেনা ও বিনিময় পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মা ইলিশ সুরক্ষা, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি, জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশের সুষ্ঠু প্রজনন নিশ্চিত করাই হচ্ছে এই নিষেধাজ্ঞার মূল উদ্দেশ্য। মা ইলিশ রক্ষার পাশাপাশি জাটকা নিধন রোধ করা গেলে আগামিতে ইলিশের উৎপাদন কাক্সিক্ষত পরিমাণে বাড়বে। বাজারে ইলিশ সহজলভ্য হবে। এতে ইলিশের চাহিদা পূরণ সহজ হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিচাহিদা মেটাতেও ইলিশ ভূমিকা রাখবে। ইলিশ শিকারি বা জেলেদের সাময়িক অসুবিধা হলেও বৃহত্তর স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত খুবই ইতিবাচক বলতে হবে। তবে সিদ্ধান্তের যথাযথ বাস্তবায়নের ওপরই সাফল্য নির্ভর করছে।

জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে দেশব্যাপী তদারকি ও নজরদারির যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মৎস্যজীবীরা সরকারের ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা মেনে চলছে। ইলিশের বেচাকেনাও বন্ধ আছে বাজারে। তবে কিছু অসুদপায়ী জেলে অবৈধভাবে ইলিশ আহরণে নিয়োজিত রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মা ইলিশ শিকারের দায়ে গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক জেলেকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- ও জরিমানা করা হয়। প্রশাসনের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব অভিযান পরিচালনা করেন। মা ইলিশ রক্ষায় প্রশাসনের এমন পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কঠোর অবস্থানে থাকলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার সাহস দেখাবে না কেউ। তবে অভিযোগ আছে, বাংলাদেশে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সুযোগে ভারতীয় জেলেরা সাগরে ইলিশ শিকারে নেমে পড়েছে। এ অভিযোগ আমলযোগ্য। সরকারের উচিত হবে, আগামিতে ভারতের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রজনন মৌসুমে যৌথভাবে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। এতে ভালো ফল আসবে। নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নানা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলছে, ইলিশ শিকারের এই স্বল্প মেয়াদ সঠিক নয়। ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনেক আগে থেকেই মা ইলিশ ধরার পড়ে। গত মাসে সাগরে যে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছে তাতে অধিকাংশ ইলিশের পেটে ডিম ছিল। এসব ইলিশ তখন ডিম ছাড়ার জন্য উপকূলের নদ-নদীতে আসছিল। আবার প্রজনন বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঘোষিত প্রজনন মৌসুম শেষ হওয়ার পরেও ইলিশ ডিম ছাড়বে। গত বছরও নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর জেলেরা ইলিশ আহরণে নামলেও প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়ছিল ডিমওয়ালা ইলিশ। প্রতি বছরই এমন চিত্র দেখা যায়। কিন্তু তারপরও নিষেধাজ্ঞার সময় বাড়ানো হয় না কেনো তা বোধগম্য নয়। উল্লেখ্য, চলতি বছর বাজারে প্রচুর পরিমাণে বড় ইলিশ বিক্রি হয়েছে। সাগর ও নদ-নদীতে ধরা পড়া ইলিশের গড় ওজন গত তিন বছরে ৩৫০ গ্রাম বেড়েছে। আকার ও ওজন বৃদ্ধির পাশাপাশি এবার ইলিশের মোট উৎপাদনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে। এর মূল কারণ এবছর বঙ্গোপসাগরে ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোতে জাটকা ধরা বন্ধ করা এবং নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ধরা বন্ধ করার কারণে ধারাবাহিকভাবে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে পুরো নভেম্বর পর্যন্ত করা গেলে অসংখ্য মা ইলিশ রক্ষা পাবে। এতে হাজার হাজার কোটি নতুন ইলিশ মৎস্যসম্পদে যুক্ত হবে।

ইলিশ উচ্চ-উৎপাদনশীল। বড় আকারের একটি ইলিশ ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, একটা পরিপূর্ণ মা ইলিশ কমপক্ষে ১০ লাখ ৩০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১৯ লাখ ১৪ হাজার অর্থাৎ গড়ে ১৪ লাখ ডিম ছাড়তে সক্ষম। তাই যত বেশি মা ইলিশ রক্ষা করা যাবে ইলিশের পরিমাণ তত বেশি বৃদ্ধি পাবে। এ কথা ঠিক যে, ইলিশ মূলত সারা বছরই ডিম দিয়ে থাকে। তবে, আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে-পরেই সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। আবার পূর্ণিমার আগের চেয়ে পরের দিনগুলোতে ইলিশের প্রজনন অনেক বেশি হয়ে থাকে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ইলিশ এ সময় ডিম ছাড়ে। তাই এই সময়টাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার পরিধিও এ সময়ে বাড়ানো দরকার। এতে সাগর ও উপকূল থেকে ধেয়ে আসা প্রজননক্ষম মা ইলিশ নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ পাবে।

ইলিশের প্রজনন ন্যাচারাল প্যারামিটারের উপর নির্ভর করায় প্রকৃতিনির্ভর পরিকল্পনা নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে প্রজনন মৌসুমের সময়সীমা নির্ধারণ করা উচিত। প্রসঙ্গত, ডিম ছাড়ার আগে পরিবেশের সাথে খাপ-খাওয়াতে মা ইলিশ কয়েকদিন নদীতে বাস করে। তাই প্রজনন মৌসুমের সময়সীমা বাড়িয়ে তিন মাস করা হলে মা ইলিশ তুলনামূলক কম ধরা পড়বে। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে চাইলে অবশ্যই এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ ও নজরদারী থাকতে হবে। একইসঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমায় যাতে পার্শ্ববর্তী দেশের মাছ ধরার ট্রলার না ঢুকতে পারে, সেজন্য নজরদারি বাড়াতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট