চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

ছাত্ররাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

১৮ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৫৯ পূর্বাহ্ণ

রাজনীতির অর্থ রাজার নীতি বা নীতির রাজা যেটাই হোক না কেন, এর মূল বিষয় কোন রাষ্ট্রের শাসননীতি চর্চা করা। অর্থাৎ সরকারের মূলনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করা। এ বিশ্লেষণ সরকারের নীতির অনুকূলেও হতে পারে আবার প্রতিকূলেও হতে পারে। সুতরাং সরকারের নীতিমালার পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান করে ঐ নীতিমালা বাস্তবায়ন বা প্রবর্তন, সংশোধন, সংস্কার, বা নতুন কোন নীতি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি পালন করাকে রাজনীতি বলা হয়। ছাত্ররাজনীতি বলতেও আমরা দুটি অর্থ বুঝে থাকি। এক, ছাত্রজীবনে রাজনীতি। দুই, ছাত্র সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে রাজনীতি। অতএব সাধারণ রাজনীতির সংজ্ঞার আলোকে ছাত্ররাজনীতির অর্থ দাঁড়ায়, ছাত্রজীবনে রাষ্ট্রের বা সরকারের মৌলনীতি ও কার্যকলাপের বিশ্লেষণ করা এবং এ নীতির সমর্থনে বা বিরোধিতায় সুনিদিষ্ট কর্মসূচি পালন করা অথবা অন্য কোন নীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কর্মসূচি পালন করা। সরকারের নীতির ও কার্যকলাপের বিশ্লেষণ দু’ভাবে হতে পারে। এক, আলোচনা-সমালোচনা, সেমিনার- সিম্পোজিয়াম, বক্তব্য বিবৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে। দুই, সভা-সমাবেশ মিছিল মিটিং, হরতাল, অসহযোগ ইত্যাদি মাঠ-ময়দান রাজপথভিত্তিক কঠিন কর্মসূচির মাধ্যমে।

আমাদের দেশে উল্লেখিত উভয় প্রকার কর্মসূচির ছাত্ররাজনীতি চর্চা হয়ে আসছে। বিশেষত ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের যাঁতাকল থেকে এ দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য কর্মজীবী ও পেশাজীবী মানুষের পাশাপাশি ছাত্রসমাজও রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের ভূমিকা আরও সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় হয়। বিশ শতকের শেষার্ধে সংঘটিত বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন এবং ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সংঘটিত আন্দোলন সংগ্রামেও ছাত্রসমাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এক কথায় বৃটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৯০ এর গণঅভ্যূত্থান পর্যন্ত সব রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রসমাজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। এখন বাংলাদেশ স্বাধীন। বিদেশি শত্রু ও তাদের নিষ্পেষণ থেকে এদেশের জনগণ মুক্ত। ভাষা, চাকুরী, শাসন সবকিছুর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এখন নিজেদের হাতে। প্রশ্ন হচ্ছে, এরপরও কি ছাত্রজীবনে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার বা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করার প্রয়োজন আছে? প্রয়োজন থাকলে সেটা কি দলীয় রাজনীতির লেজুড়ভিত্তিক, না কি লেজুড়হীন। অথবা ছাত্ররজানীতি কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাবিষয়ক, না কি জাতীয় ইস্যুকেন্দ্রিক। এসব বিষয় নিয়ে এখন রীতিমত বাহাস চলছে। যদিও এ বাহাসের সূচনা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে ঢাবিতে সেভেন মার্ডারের পর থেকে। ১৯৮৬ ও ১৯৮৯ সালে এইচএম এরশাদের আমলেও ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ছাত্ররাজনীতির কারণে শিক্ষাঙ্গন রক্তে রঞ্জিত হওয়া, শিক্ষাকার্যক্রম ব্যহত হওয়া এবং তথাকথিত ছাত্রনেতাদের নানান অপকর্মের কারণে এ ইস্যু জাতির সামনে বার বার এসেছে। গত ৬ অক্টোবর বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহদের নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর থেকে এটি আবার প্রধান ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে বহু মতামত এসেছে। অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ভূমিকা, আগামীর রাজনীতিবিদ সৃষ্টি, অপশক্তির উত্থান ঠেকানো ইত্যাদি যুক্তিতে ছাত্ররাজনীতি চালু রাখার পক্ষে মতামত দিচ্ছেন এক পক্ষ। অন্য পক্ষ বলছেন, ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হয়েছে। চাঁদাবাজি, মাস্তানি, টেন্ডারবাজি, মদ্যপান, খুন-খারাবি, তদবিরবাজি ইত্যাদির সাথে জড়িয়ে পড়েছে ছাত্রনেতারা। টর্চার সেল, র‌্যাগিং রোম ইত্যাদি এখন গোপন কিছু নয়। নিয়োগবাণিজ্যা, ভর্তিবাণিজ্য, সিট বরাদ্দের ধান্ধা, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ, আইনের তোয়াক্কা না করা ইত্যাদি ছাত্রনেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে। অতএব এমন ছাত্ররাজনীতির কোন প্রয়োজন নেই। কারো কারো দাবি হলো, লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা হোক। উন্নত বিশ্বে ছাত্ররাজনীতি নেই, কিন্তু তারা কি দৃঢ় নেতৃত্ব দিচ্ছেন না- এমন প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আরো যুক্তি হলো, বড় বড় রাজনীতিবিদদের ছেলে-মেয়েরা এর সাথে জড়িত নেই। আমলাদের ছেলেমেয়েরাও নেই। নেই কোন ধনাঢ্য পরিবারের ছেলেমেয়ে। তাহলে সহজে অনুমেয় সাধারণ জনগণের মেধাবী ছেলেমেয়েরা এর সাথে সম্পৃক্ত এবং এর মন্দ পরিণতির শিকারও তারা। অতএব এমন ছাত্ররাজনীতি কার স্বার্থে? এমন প্রশ্ন এখন জনগণের।

অভিভাবকরাও চান না যে, তাঁদের ছেলেমেয়ে ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়–ক। অপরদিকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর আইনে ছাত্ররাজনীতির কথা নেই। আছে ছাত্রসংসদের কথা। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে আইনের উল্টো দিকে। অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই আইনের বিপরীত চলার প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বর্তমান দলীয় ছাত্ররাজনীতির প্রতি সিংহভাগ জনগণের সমর্থন নেই। যাদের সমর্থন আছে তারা নিজেদের স্বার্থে শিক্ষার্থীদেরকে ব্যবহার করছেন মাত্র- এমন অভিযোগও আছে বিপক্ষীয়দের পক্ষ থেকে। কারণ, যদি তাদের আন্তরিকতা থাকত তাহলে তাদের ছেলেমেয়েরা সেই রাজনীতিতে নেই কেন? মোটামুটি বর্তমান বিশ্লেষণে এ বিষয়ে মূল তিনটি পক্ষ পাওয়া যাচ্ছে। এক. ছাত্ররাজনীতি একেবারে বন্ধ করা দুই. বন্ধ না করে গুণগত পরিবর্তন আনা। তিন. লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা। মূলত প্রত্যেকটি দাবির পক্ষে যুক্তি আছে। তবে ছাত্ররাজনীতিতে সংস্কার আনতে হবে- এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। বন্ধ করা হোক বা সংস্কার করা হোক- যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভূমিকা রাখতে হবে শিক্ষকসমাজ ও অভিভাবকদেরকে। অন্যথায় যেকোন সিদ্ধান্ত অতীতের মত ভেস্তে যাবে, যেভাবে ৮৬ ও ৮৯ সালে গৃহীত সিদ্ধান্ত ভেস্তে গিয়েছিল।

এক ছাত্রনেতার প্রশ্ন হলো, দলীয় রাজনীতি কি নিষ্কলুষ? কলুষিত হওয়ার কারণে যদি ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হয় তাহলে তো দলীয় রাজনীতিও বন্ধ করতে হবে! এ যুক্তিও অগ্রাহ্য নয়। কারণ, আবরার ফাহাদের খুনিরা কেউ খুনি হিসেবে বুয়েটে ভর্তি হয়নি। মেধা যাচাইয়ের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তারা জায়গা করে নিয়েছিল বুয়েটের মেধাবীদের কাতারে। কিন্তু অপরাধের সাথে জড়িত হওয়ার কারণে তারা এখন কঠিন শাস্তির মুখোমুখি। ইতিমধ্যে তাদের গর্বের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেছে। অভিভাবকদের আশায় পড়েছে গুড়েবালি। কয়েকবছর পর যারা ভাল স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ-জাতির সেবা করার কথা ছিল তারা আজকে পুলিশ রিমান্ডে। তাদের মা-বাবার প্রশ্ন, আমি তো আমার ছেলেটাকে বুয়েটের উপয্ক্তু করে বুকভরা আশা নিয়ে পাঠিয়েছিলাম। আমার ছেলে আজকে খুনি হলো কেন? কারা এ জন্য দায়ী? এর উত্তর দিতে গেলে কেঁচো খুঁজতে সাপ বেরিয়ে আসবে। দায়ী হবে দলীয় কলুষিত রাজনীতি এবং সংশ্লিষ্টরা। তাই ছাত্ররাজনীতির পূর্বে দলীয় রাজনীতিতে গুণগত পরির্বতন ও সংস্কার আনতে হবে। আর ছাত্ররাজনীতির ভাল দিকগুলো বিবেচনাপূর্বক এতে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ, রাজনীতি একটি বিজ্ঞান। পুঁথিগত বিদ্যাকে ভালভাবে কাজে লাগাতে হলে সাংগঠনিক জ্ঞান ও আচরণ রপ্ত করাও জরুরি। জনগণের মন জয় করার গুণাবলী রপ্ত করার শিক্ষাও নিতে হবে ছাত্রজীবন থেকে। দেশপ্রেম, মানবসেবা, সমাজমুখিতার প্রশিক্ষণও নিতে এসময়ে। তাই সচেতন মহল ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে আগত প্রস্তাবগুলোর সমন্বয় করা যায় এভাবে যে, ছাত্ররাজনীতি হবে দলীয় লেজুড়হীন, ছাত্রসংসদভিত্তিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার উন্নয়নকেন্দ্রিক। তবে তা পরিণত বয়সের আগে নয় অর্থাৎ ডিগ্রি-অনার্স লেবেলের আগে নয়। কারণ, যেকোন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব থাকা আবশ্যক। সেই জন্যেই ছাত্রসংসদ। তবে উচ্চমাধ্যমিকের লেখাপড়া শেষ করার আগে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া অনুচিত। জাতিসংঘের হিসাব মতে, একজন ব্যক্তি আঠারো বছর পর্যন্ত শিশু। একজন শিক্ষার্থীর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করতে সাধারণত আঠারো বছর কেটে যায়। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় বা সেলেবেলে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা শিশু। সুতরাং শিশুরাজনীতি বন্ধ করার স্বার্থেও এটি প্রয়োজন। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে প্রত্যেক মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক মানের বিদ্যালয়কে পর্যায়ক্রমে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে উন্নিত করার কথা আছে, যেগুলো শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। এসময়ে মুক্তচিন্তা চর্চার যেমন বিষয় নেই তেমনি জাতীয় ইস্যু নিয়ে চিন্তা করারও প্রয়োজন নেই। তাই তাদেরকে যেকোন ধরনের রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এরপর তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গিয়ে আপন আপন ইচ্ছা ও অবস্থান অনুযায়ী ছাত্রসংসদের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের সৎচরিত্র, মেধা, বিচক্ষণতা, শিষ্টাচার, পরোপকারিতা ইত্যাদি গুণের জোরে শিক্ষার্থীদের মন জয় করে ছাত্রসংসদের নেতা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের ন্যায় ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলে সে নির্বাচনের প্রতিদ্ধন্ধিতা করে তারা জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা বলবে এবং কর্মসূচি পালন করবে। এমন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চা পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতেও গুণগত পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে। এবিষয়ে সর্বমহলের একমত প্রতিষ্ঠাই এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট