চট্টগ্রাম শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪

৩ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৩১ পূর্বাহ্ণ

পুরুষ ও নারী দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে বিবাহ বলে। পরিবার গঠনের জন্য বিবাহ একটি মৌলিক উপাদান। আরব দেশে ইসলাম প্রচারের শুরুতে বহু ধরনের বিবাহ প্রচলিত ছিল। এগুলোর মধ্যে একটি ছাড়া অন্যান্য ধরনের বিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ। মুখ্যত যে ধরনের বিয়ে ইসলামে অনুমোদিত হয়েছে তা হলো সাবালিকার স্বাধীন সম্মতি নিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন। মুসলিম সমাজে সর্বযুগে এরূপ বিয়েই অনুমোদিত।

বিয়ের উদ্দেশ্য: পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেছেন – মানুষের জন্য আল্লাহর একটি নিদর্শন হলো এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের জন্য সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা পরস্পরের সথে শান্তিতে বসবাস করতে পার এবং তোমাদের মধ্যে সৃস্টি করেছেন ভালবাসা এবং দয়া’ (সূরা- ৩০ আর রূম, আয়াত – ২১)।
আয়াতে চারটি বিষয়কে বিবাহের উদ্দেশ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে।
১.স্থিরতার সাথে বসবাস ২.শান্তি ৩. ভালবাসা ৪.সহমর্মিতা
যে পরিবারে পারস্পরিক ভালবাসা নেই, দয়া নেই, বিবেচনা নেই, সমঝোতা নেই, তা হতে পারে না সুষ্ঠু মানব পরিবার। ভালবাসা, দয়া এবং মায়া ছাড়া বৈবাহিক সম্পর্কের আর কী মজবুত বন্ধন থাকতে পারে? শুধুমাত্র যৌনসম্ভোগের মধ্যে বন্ধন স্থাপিত হয় না। ভোগের পরেই আসে ত্যাগ। ভালবাসা, সহানুভ’তি এবং দয়ার সম্পর্কটিকে আল্লাহ এত বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন যে এগুলো আল্লাহর নিদর্শন।
মানব জাতির প্রথম পরিবার সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেছেন- ‘তিনিই তোমাদেরকে এক প্রাণ হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার সঙ্গিনীর সৃষ্টি করেন যেন সে তার নিকট থেকে পায় শান্তি ও সুখময় বসবাস’ (সূরা -৭ আ’রফ, আয়াত -১৮৯)।
বিবাহের উদ্দেশ্যের মধ্যে এই শান্তি ও ভালবাসা ছাড়াও সন্তান- সন্ততি জন্মদান, কামনা বাসনা পূরণও রয়েছে। কেবল পশুবৃত্তিকে চরিতার্থ করা নয় বা শুধূমাত্র সাংসারিক জীবনের একজন সাথী তালাশ করাই নয়, বরং বিয়ের মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ও রাসূল (স.) এর আদর্শ (সুন্নাত তরীকা ) অনুসারে দু’জন মানুষ (স্বামী – স্ত্রী) পরপস্পর জীবন সাথী হয়ে দুনিয়াতে আপন আপন দায়িত্ব পালন করে দুনিয়া ও আখিরাতের কাজে একে অপরকে সহায়তা করা।

পাত্রী নির্বাচন:
বিশ্ব নবী (স.) বলেছেন – ‘ সাধারণত একজন নারীকে চারটি গুণের জন্য বিয়ে করা হয়। এগুলো হলো
১.তার সম্পদ ২. বংশ ৩. সৌন্দর্য এবং ৪. ধর্মপরায়ণতা। এক্ষেত্রে ধর্মপরায়ণ নারীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যে কোন মূল্যে’ (বুখারী ও মুসলিম)। বিয়ের গুরুত্ব ও দায়িত্ব: বিয়ে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক এবং পারিবারিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পরিকল্পিতভাবে গ্রহণ করতে হয়। দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা আছে কি নেই , তা বিবেচনা না করে সুযোগ পেলেই কেউ বিয়ে করতে পারেনা। কারণ, স্ত্রী সাংসার এবং চরিত্র, ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রাখা স্বামী – স্ত্রী উভয়ের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জিত না হলে অপেক্ষা করাই শ্রেয়।
রাসূল (স.) বলেছেন – ‘ হে যুবকগণ! তোমাদের মধ্যে যারা দাম্পত্য জীবনে দায়িত্ব পালনে সমর্থ, তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হও। কারণ, বিয়ে দৃষ্টিকে সংযত করে এবং গুপ্তাঙ্গকে সংরক্ষিত রাখে। আর যার সামর্থ্য নেই তার উচিত হবে রোযা রাখা। কারণ, তা তার জন্য ঢাকনাস্বরূপ’ (বুখারী ও মুসলিম)।
বিয়েবহির্ভূত যৌনসম্ভোগ ইসলামে অনুমোদন করে না। বিয়ের মাধ্যমে দাম্পত্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। বিয়ে হলো আল্লাহর নবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ এবং সুন্নাহ। চিরকুমার থাকা ইসলামী প্রথা নয়। সখ তামাসা এবং ফ্যাশন হিসাবে চিরকুমার / চিরকুমারী থাকা ইসলামে নিন্দনীয়।
রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন- বিয়ে আমার একটি আদর্শ, যে ব্যক্তি আমার এ আদর্শ ত্যাগ করবে সে আমার উম্মত নয়।’
সংসার জীবনযাত্রা এবং বিয়ের উপর মহানবী (স.) কর্তৃক এত অধিক গুরুত্ব আরোপ করা সত্ত্বেও বিয়ে প্রত্যেক মুসলিম নর – নারীর জন্য ফরযে আইন করা হয়নি। অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত বা অন্যান্য কারণে বিয়ে বিলম্ব করতে পারে, যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অবস্থার পরিবর্তন করেন। যদি সঙ্গত কারণ থাকে, তাহলে বিবাহ বন্ধনে কেউ জীবনে মোটেও আবদ্ধ না-ও হতে পারে।

বিয়ের বয়স: কোন বয়সে বিবাহ সম্পাদিত হবে তা বিবেচিত হয় শারীরিক ও জৈবিক প্রয়োজন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক এবং জনসংখ্যা দিয়ে। তাছাড়া গর্ভধারণের বয়সে উন্নীত হবার পূর্বেই অল্প বয়সী বালিকাদের বিয়ে দিলে পরবর্তীতে যে গর্ভসঞ্চার হবে তা শিশু এবং মা উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে। নব – বিবাহিত দম্পতি তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম কি -না তাও লক্ষ্য রাখতে হয়।

কম বয়সী ছেলে মেয়েদের মধ্যে বিবাহ সম্পাদিত হলে পবিত্র কুরআনে যে শান্তি ও সুষমার কথা বলা হয়েছে তা বিপর্যস্ত হতে পারে। জনসংখ্যা তত্ত্বের দিক দিয়েও অপেক্ষাকৃত অধিক বয়সে বিয়ে সুবিধাজনক।
ইমাম আবু হানীফা (র.) বিয়ের বয়স ছেলেদের জন্য ১৮ বছর এবং মেয়েদের জন্য ১৭ বছর উল্লেখ করেছেন বলে কোথাও কোথাও উল্লেখ আছে (আল – স্ইাহ , ১৯৭৪)। এ তথ্য প্রথম মহা যুদ্ধের পূর্বে ওসমানিয়া পারিবারিক আইনে উল্লেখ করা হতো। ওসমানিয় খেলাফতের পর তুর্কী আইনেরও পরিবর্তন হয়েছে। ইদানীং বহু মুসলিম দেশে বিয়ের বয়স নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তা ১৭/১৮ বছরের কাছাকাছি। তিউনিসিয়ায় কনের বয়স নুন্যতম ১৭ এবং বরের বয়স ১৮ হতে হবে, অন্যথায় ঐ বিয়ে আইনসিদ্ধ হবে না। বাংলাদেশে বর্তমান বিদ্যমান আইনে বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স হল – ছেলেদের ২১ বছর এবং মেয়েদের ১৮ বছর।

বিয়ের উপযুক্ত ক্ষেত্র: পাত্রী নির্বাচনের সময় পরবর্তী প্রজন্মের মান বজায় রাখার প্রতি সচেতন থাকতে মহানবী (স.) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘ কোথয় তুমি বংশ বৃদ্ধির জন্য শুক্র স্থাপন করবে, তা বেছে নেবে। ’
মহানবী (স.) বলেন, ‘নিকট আত্মীয়স্বজনের বাইরে বিয়ে করো। পাছে তোমার সন্তান ক্ষীণকায় বা মেধাহীন হয়। ’ অল সাইব গোত্রের লোকেরা নিজেদের মধ্যেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতো। হযরত উমর (রাদি.) ঐ গোত্রের লোকদেরকে বলেছিলেন, ‘হে, সাইব গোত্রের লোকজন! তোমাদের সন্তান – সন্ততি দুর্বল ও ক্ষীণকায় হয়ে যাচ্ছে, তোমাদের উচিত নিজ গোত্রের বাইরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া’ (ইব্রাহিম আল হারবী)।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বংশগত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে ক্রমাগত নিকট আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিয় সম্পাদিত হলে জন্ম এবং বংশ ধারায় নানবিধ বিপত্তি দেখা দেয়। উপরোক্ত বক্তব্য সত্ত্বেও আমরা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করবো যে নিকট আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। হযরত আলী (রাদি.) এবং সাইয়্যেদা ফাতিমা (রাদি.) এর মধ্যে বিয়ে আল্লাহর নবী (স.) এর সম্মতিক্রমেই হয়েছিল। কিন্তু উক্ত পরিবারের সকলেই ছিলেন সুস্বাস্থ্যবান। যাহোক, যদি কোন পরিবারের মধ্যে বংশগত রোগ দেখা দেয় এবং সন্তান সন্ততি ক্ষদ্রকার ও মেধাহীন দেখা যায়, সে বংশের আত্মীয় – স্বজনের মধ্যে আন্তঃবিবাহ না হওয়াই বাঞ্জনীয়।

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট