চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

জ্ঞান সাধনায় লাইব্রেরি

মোহাম্মাদ কুতুব উদ্দীন

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০১ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বস্রষ্ট্রা মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.) এর কাছে যে আসমানী নির্দেশটি সর্বপ্রথম পাঠিয়েছিলেন সেটি হচ্ছে ‘ইক্বরা’ মানে পড়। হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টির পরপরই যে প্রতিযোগিতার মুখোমুখী হতে হয়েছিল সেটি হচ্ছে “জ্ঞান” আর আদম (আ.) সে প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন বলেই আমরা আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা।

বর্তমান সময়েও যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ও সেরা তাদেরকে বিশেষ সম্মান দেয়া হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন মুসলিম ও অমুসলিম মনীষীগণ পৃথিবীর একমাত্র নির্ভুল গ্রন্থ আল-কোরআনের অনুবাদ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলা ভাষায় প্রথম কোরআন শরীফ অনুবাদ করেন গিরিশ চন্দ্র সেন, ইংরেজি ভাষায় আলেকজান্ডার বস, ফরাসি ভাষায় আন্দ্রে ডুরোয়ার, উর্দু ভাষায় অব্দুস সালাম মুহাম্মদ, ফার্সি ভাষায় কামালুদ্দীন হোসাইন, হিন্দি ভাষায় আহমদ শাহ মসিহি, কাশ্মিরি ভাষায় মুহাম্মদ ইয়াহইয়া শাহ, জার্মান ভাষায় সলেম স্কেইজার, ইতালিয়ান ভাষায় আন্দ্রে অ্যারি ভ্যারিনি, রুশ ভাষায় পিওটর ভি পেস্টানিকভ, গুজরাটি ভাষায় কারিরি লোকনান, রুমানিয়া ভাষায় সিলডেস্টোও কন্ট্রাভিয়ান, চীনা ভাষায় টিয়েং লি, আফ্রিকান ভাষায় ইসমাইল আব্দুর রাজ্জাক, সুদানী ভাষায় এইচ কামরুদ্দীন সালেহ এবং কোরিয়ান ভাষায় মংসান কিম প্রথম কুরআন শরীফ অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছেন তাদের জ্ঞান সাধনার কারণেই।

জ্ঞান সাধনার একটি সহায়ক শক্তি হিসাবে লাইব্রেরি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। তাই যুগে যুগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মনীষীগণ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার “দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেস”। এতে বই রয়েছে ২৮ মিলিয়ন। পাবলিক লাইব্রেরি শাহবাগ, প্রায় দুই লাখ বইয়ের এক বিশাল রাজ্য, প্রায় এক লাখের মতো বই সংগ্রহে রয়েছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র লাইব্রেরিতে, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে ২৫ হাজার বইয়ের বিশাল এক সংগ্রহশালা, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ লাইব্রেরিতে প্রায় সাত হাজার বই এবং গ্যেটে ইনস্টিটিউট লাইব্রেরি পাঁচ হাজারেরও বেশি বইয়ের মাধ্যমে আলোকিত মানুষ তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রায় ৪ লক্ষাধিক বই নিয়ে জ্ঞান সাধনায় ভূমিকা রাখছে। তবে দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, শতকরা প্রায় ১০ ভাগ শিক্ষার্থী তার নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার ব্যবহার করে না। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার কারণে প্রায় ৩৫% মানুষ এখনও অক্ষরজ্ঞানহীন, বইয়ের পরিবর্তে যুব সমাজ এখন মাদকাসক্তে ডুবে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে এসেছে বছরে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ তামাকের কারণে প্রাণ হারান। একই কারণে চার লাখ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেন। বর্তমানে প্রতিবছর তামাকজনিত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। তাই মানুষকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলতে মধ্যযুগের মুসলমানরা বিশ্বময় আলো ছড়ানোর জন্য ব্যাপকভাবে লাইব্রেরি গড়ে তোলেছিলেন। ৮৩০ সালে খলীফা আল মামুন বায়তুল হিকমা নামে বিশাল এক গ্রন্থশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ ছাড়া কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তৎকালীন সেই পাঠাগারে সংরক্ষিত ছিল ছয় লাখ গ্রন্থ। চতুর্থ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মুসলিম পন্ডিত ও প্রশাসক সায়েব বিন আব্বাস আরব জাহানে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রবর্তন করেন। ১৯১২ সালে আমেরিকা অঞ্চলে ঘোড়ার গাড়ির মাধ্যমে পাঠাগার যাতায়াত করত বিভিন্ন লোকালয়ে। ফ্রান্সে এটা শুরু হয় ১৯২০ সালে। বর্তমান পৃথিবীতে গাড়িতে করে বহনযোগ্য গ্রন্থাগার প্রায় সব দেশেই চালু আছে। বাংলাদেশে প্রথম ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির উদ্যোগ নেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। আধুনিককালে তুরস্কের ‘সোলাইমানিয়া’ লাইব্রেরিটির অবস্থান শীর্ষে। পর্যায়ক্রমে মিসরের দারুল কুতুব, ইরাকে আব্দুল্লাহ মারাশি নাজাফি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত লাইব্রেরি, পবিত্র মদীনার মাকতাব আল আবদুল আজীজ অগ্রগণ্য। নোবেল বিজয়ী লিও টলস্টয়কে বলা হয়েছিল জাতীয় উন্নয়নের জন্য আপনি যুব সমাজের প্রতি কিছু বলুন, তিনি বলেছিলেন আমার তিনটি পরামর্শ আছে : ১. পড়, ২. পড় ৩. আর পড়। এটি যেন মহান আল্লাহর সেই প্রথম বাণী “পড়, তোমার প্রভুর নামে” এরই প্রতিফলন। আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জ্ঞানের দিগন্তকে আলোকিত করতে ভালো মানের সমৃদ্ধ লাইব্রেরির বিকল্প নেই। মানুষের হাজার হাজার বছরের লিখিত-অলিখিত সব ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে একেকটি গ্রন্থাগারের ছোট ছোট তাকে। এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি জ্ঞান সাধনায় লাইব্রেরির গুরুত্ব কতটুকু।

লেখক : প্রভাষক, জলদী হোসাইনিয়া কামিল মাদরাসা, বাঁশখালী,চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট