চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

হিজরি সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম

২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৪ পূর্বাহ্ণ

ইসলামী ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হিজরি সন। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক জাতি, গোষ্ঠি ও ধর্মাবলম্বীর রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে যেকোন জাতি, গোষ্ঠি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিচয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা সৃষ্টি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ অন ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন এর মতে, ‘সামাজিক আচরণ এবং মিথষ্ক্রিয়ার ধরন, জ্ঞানীয় গঠন এবং সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে যে বুঝ অর্জিত হয় সেটাই সংস্কৃতি।’ সুতরাং যেকোন জাতি-গোষ্ঠির জন্য সংস্কৃতি খুবই গুরত্বপূর্ণ উপাদান। যে জাতি নিজস্ব সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ভুলে বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করে ও লালন করে, সে জাতির অস্তিত্ব হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। আর যে জাতি নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধারণ করে, লালন করে এবং তা উন্নত-সমৃদ্ধ করার প্রয়াসী হয়, সে জাতি বিশ্বদরবারে সম্মানিত হয়।

বাঙালি জাতির চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সভ্য সমাজের প্রেক্ষাপটে আজ এক অনন্য উচ্চতায় আসীন। বাংলাদেশ নামক এ দেশের মানবগোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম ইত্যাদি ইতিহাসের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংমিশ্রণ, সংযোজন এবং সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে উপনীত হয়েছে। যাকে হাজার বছরের ঐতিহ্য রূপে আখ্যায়িত করে আমরা গর্ব করি। আমরা বাঙালি হলেও আমাদের আরেকটি পরিচয় আছে, সেই পরিচয়টিও সভ্যতার পরিচয়ে সমুন্নত। তা হলো ‘মুসলমান’। মুসলমান জাতির নিজস্ব গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য-সংস্কৃতি।
বলা হয়, যে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি যত সমৃদ্ধ, সে জাতি বিশ্বের বুকে তত সভ্য ও উন্নত। নববর্ষ বা নওরোজ উদযাপন পৃথিবীর প্রায় জাতির জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভুক্ত। সারা বিশ্বে যুগে যুগে কালে কালে নববর্ষ উদযাপনের সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল, আছে ও থাকবে।

আমাদের দেশে বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘটা করে ১লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। তেমনি উদযাপন করা হয় ইংরেজি নববর্ষ। অথচ ৮৮ ভাগ মুসলমানের দেশে হিজরি নববর্ষের ব্যাপারে তেমন কোন উৎসব বা আয়োজন থাকে না। যা দুঃখজনক বটে। হিজরি সনের সম্পর্ক চন্দ্রের সঙ্গে। যেমন- পবিত্র ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, রোযা, হজ্জ, কোরবানি, যাকাত, ফিতরা, শবে বরাত, শবে কদর, শবে মিরাজ, আশুরা প্রভৃতি চন্দ্রের হিসাবে করা আবশ্যক। নিজেদের প্রয়োজনে বাঙালি মুসলমানদের বাংলা সনের পাশাপাশি ইসলামী বর্ষ তথা হিজরি সন যথাযথ অনুসরণ ও পালনে ভূমিকা রাখা একান্ত আবশ্যক রূপে প্রতীয়মান হয়।
সময় গণনায় মানুষ প্রাচীনকাল থেকে চাঁদের গতি ও প্রকৃতির প্রতি নজর রাখত। আমাদের দেশেও এখনও জোয়ার-ভাটা হিসাব, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, বিবাহ, জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, বিভিন্ন উৎসব চন্দ্র তারিখের হিসাব অনুযায়ী হয়। এজন্য আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে বলেন, ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্যকে দ্বীপ্তিমান তেজস্বী এবং চন্দ্রকে করেছেন স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময় আলোকোজ্জ্বল। আর ওর (চন্দ্রের গতির) জন্য কক্ষপথ বা মানজিলসমূহ নির্ধারিত করেছেন। যাতে তোমরা বছরসমূহের সংখ্যা গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার।’ (সূরা ইউনুস: আয়াত নং ৫)। সূরা তাওবাহ এর ৩৬ নং আয়াতেও আল্লাহপাক বার মাসে বছর সম্পর্কে বলেন,“আকাশ ম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর কাছে ও আল্লাহর বিধানে মাসের সংখ্যা ১২টি। এর মধ্যে চারটি মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান, সুতরাং এই মাসগুলোতে তোমরা যুদ্ধ করে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না। আর তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করবে, যেমন তারা তোমাদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে এবং জেনে রাখ আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন।”

হিজরি সনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদিনায় হিজরত করার সেই ঐতিহাসিক স্মৃতি। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৭ সফর রাতেই মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের ফলে মহান আল্লাহর নির্দেশে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যের হিজরত করেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
এ ঐতিহাসিক হিজরতেরই স্মৃতিবহন করে আসছে হিজরি সন। হিজরি সনের প্রবর্তন করেন খোলাফায়ে রাশেদীনের অন্যতম ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)। ৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত হিজরি সন তার এক অমর কীর্তি। হিজরি সন প্রবর্তনের এক বছর পর ৬৩৯ আরবদের আগমনের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়। মুসলমানরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন হলে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে জাতীয় সনে পরিগণিত হয়। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের দিন থেকে শুরু করে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় পর্যন্ত অর্থাৎ ১২০৯-১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ৫৫০ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর সন ছিল হিজরি সন।

হিজরি নববর্ষ পহেলা মুহররম মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক ও আনন্দের দিন। মুসলমানদের উচিত হিজরি নববর্ষ পালনের মাধ্যমে অপসংস্কৃতির বিপরীতে ইসলামী ঐতিহ্যম-িত নির্মল সুন্দর সংস্কৃতি ব্যাপক প্রচার-প্রসার করা। ইসলামী ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ এ নির্মল সুষ্ঠুধারার সৃজনশীল কর্মসূচি ও নববর্ষের আগমনী বার্তা দেশব্যাপি ছড়িয়ে দেয়া উচিত। বর্তমানে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি নববর্ষ উদযাপন ও পহেলা মুহররম সরকারি ছুটি ঘোষণার। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করবে এ প্রত্যাশা করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক; নির্বাহী সদস্য, জাতীয় হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট