চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিডনী যাত্রা ও মুগ্ধভ্রমণ

মোহাম্মদ খালেদ বিন চৌধুরী

২৭ জুন, ২০১৯ | ১:৩০ পূর্বাহ্ণ

২০১৭ সালের ২ মার্চ আমার স্ত্রী ও তিন মেয়েসহ আমি সিডনি পৌঁছাই। আমার স্ত্রী এর মামাত ভাই বাহাদুর তার এক বন্ধু সহ দুটি গাড়ি নিয়ে আমাদেরকে এয়ারপোর্ট থেকে নিতে আসল। আমরা ২ সপ্তাহ তার বাসাতেই উষ্ণ আতিথেয়তা ও আরাম আয়েশে কাটালাম। এর মধ্যে একদিন আমি আর আমার স্ত্রী দুজনে ব্যাংক একাউন্ট খুলে ফেললাম । ব্যাংক একাউন্ট খোলা খুব সহজ। আমাদের সময় লাগল ১৫ মিনিট। শুধু পাসপোর্ট এর ফটোকপি নিল। তার আগে একটি অস্ট্রেলিয়ান ফোন নাম্বার লাগবে। তাই, সবার আগে সিম নিতে হল। কোন ফর্ম পূরণ নেই। ছবি লাগে নাই। ব্যাংকে সেবা গ্রহীতা হিসেবে একটি বিষয় খেয়াল করলাম। ব্যাংক এর প্রবেশ পথে ২/৩ জন মেয়ে দাঁড়িয়ে ক্লায়েন্টদের অভ্যর্থনা জানায় ও আসার কারণ জিজ্ঞ্যেস করে। তারা নাম ও মোবাইল নাম্বার টুকে নেয়। তারপর অপেক্ষা করতে বলে। ব্যাংক-এর অফিসার তাদের কাছে গিয়ে সিরিয়াল অনুসারে ক্লায়েন্টদের নাম ধরে ডাকে। কম্পিউটার-এর সামনে বসিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে তার কাজ শেষ করে দেয়।
সিডনীর সুন্দর বীচগুলো
পৃথিবীর সব সুন্দর বীচ রয়েছে সিডনী শহরে। এদের সংখ্যা ১০০ এর ও বেশি। এই বীচগুলি বিভিন্ন আকারের। কোনটি প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে, উপসাগর বা এমনকি নদীর তীর ধরে। ৭০ টির মত সার্ফিং বীচ রয়েছে। এর সবগুলোর পানি আর বালি খুব পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ। বিখ্যাত বীচগুলি হচ্ছে – ম্যানলি, বন্দাই, মারুব্রা, ক্রনিউলা। বীচগুলির রক্ষণাবেক্ষণের মান খুব ভাল। প্রতিটি বীচে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট , চেঞ্জ রুম রয়েছে। তাছাড়া, বারবিকিউ করার জন্য অনেক ইলেকট্রিক চুলা রয়েছে। সেখানে প্রতেকে নিজের মত করে বারবিকিউ করছে। কোন হুড়োহুড়ি, প্রতিযোগিতা নেই।
আমাদের আট মাস সিডনী অবস্তান কালে ২০ থেকে ২৫ টি বীচে বেড়াতে গেছি। সিডনী হচ্ছে বীচের শহর। তবে শুধু সিডনী কেন, পুরো নিউ সাউথ ওয়েলসকে প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে রেখেছে। আমাদের দেখা উল্লেখযোগ্য বীচগুলো হল ক্রনিউলা, শেলি, ক্যাপ্টেন রবিন কুক, ওয়াটা মোল্লা। এটি রয়েল ন্যাশনাল পার্ক-এর মধ্যে অবস্থিত একটি সুন্দর বীচ। এটি কোভ , ল্যাগুন ও বীচের সমন্বয়। এর আদি নাম ছিল ওয়াটা মৌলী। অর্থ প্রবহমান পানির কাছের স্থান। এপ্রিলের ২৭ , ২০১৭ তে আমরা ওয়াটা মোল্লা বেড়াতে গেলাম । এটি হচ্ছে মহাসাগর, জলপ্রপাত, পাহাড়, শিলা এর এক মিলনস্থল ।
সাগর তীরে এক পাশে উঁচু উঁচু পাইন গাছের পাহাড়, আরেক পাশে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া জলপ্রপাত , আর এক পাশে আমাদের দেশের হাওরের মত অগভীর জলাভূমি। আর এক পাশে বিশাল প্রশান্ত মহাসাগর তো রয়েছেই। এই অগভীর জলে কিয়াকিং-এর আনন্দ আমরা কেউ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। আমাদের সাথে গিয়েছিল আর দুটি পরিবার। একটি আমার স্ত্রী এর খালাত ভাই, তার স্ত্রী, আর দুই মেয়ে। তারা ১০ বছর ধরে সিডনী আছে। আর, একটি পরিবার ছিল তারা হচ্ছে আমার স্ত্রী-এর মামার শ্যালিকা, তার স্বামী , ও তাদের এক ছেলে। খালু নাকি দেশে রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় ছিলেন।
জাহাঙ্গীর কবির নানক, মীর্জা আযম -এর সম পর্যায়ের নেতা ও বন্ধু ছিলেন। তিনি নাকি ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর নিরাপদে দেশ ছাড়তে পারা সৌভাগ্যবানদের একজন। খালু বাচ্চাদের জন্য নানা রকমের কুকিজ , চকোলেট, এর বিশাল ভা-ার নিয়ে গেলেন ।
সিডনীতে বীচগুলোর মধ্যে ক্লিফ ব্রিজ, ও কেপ সাল্ভাদর এ গেছি। সাল্ভাদর এর ক্লিফ এ ছবি তুললাম যা এক দুঃসাহসিক কাজ এর মত মনে হল নিজের কাছে ছবি দেখার পর। তা ছাড়া, সার্কুলার কি, অপেরা হাউজ, সিডনী হারবার ব্রিজ এ ৩/ ৪ বার গেছি।
¯েœা মাউন্টেইনস ভ্রমণ
আমার ছোট মেয়ের অনেক দিনের ইচ্ছে, সে তুষারপাত দেখবে ও তুষারের মধ্যে খেলবে ও গড়াগড়ি খাবে। নিউ সাউথ ওয়েলস-এ এই তুষার দেখা যায় ¯েœা মাউন্টেইনস-এ। এটি হচ্ছে কতগুলো পর্বতের সমষ্টি। এই পর্বতমালা তে রয়েছে কসসিয়াস্ক নামে অস্ট্রেলিয়া এর সর্ব উচ্চ পর্বত। এর উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ২২২৮ মিটার উপরে। তাছাড়া, পেরিসার স্কি রিসোর্ট নামে ১২ কিলোমিটারব্যাপী স্কি করার জন্য স্কোপ রয়েছে। এই বিশাল এলাকাতে জুলাই মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারি তুষারপাত হয়, যা গড়ে ৭৫-৮০ ইঞ্চি গভীর হয়ে থাকে। তাপমাত্রা নেমে গিয়ে মাইনাস ৩০ -৩৫ ডিগ্রি তে পৌঁছায়। এই ২-৩ মাস পুরো ২০ -৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা সাদা তুষার এ ঢেকে যায়।
যা হোক, বাচ্চাদের এই ইচ্ছে পূরণের জন্য আমার খালাত শ্যালক মিজান ভাই পরিকল্পনা করছিল আগে থেকে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হল জুলাই মাসের ১৫ তারিখ। তিনি আবহাওয়ার গতিবিধি ১৫- ২০ দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে ১৫ তারিখ ঠিক করলেন। তো পরিকল্পনা মত তিনি আমাদের ৫ জনকে যাত্রার আগের দিন বিকেলে এসে তার বাসাতে নিয়ে গেলেন। তার ৭ সিটের গাড়ি নিয়ে যাবেন। তিনি আর তার বড় মেয়ে সোহা সহ আমরা ৭ জন যাত্রা করলাম ভোর ৪ টার সময়। অস্ট্রেলিয়া বা উন্নত দেশগুলোতে গাড়িতে যাত্রীসংখ্যা সিট সংখ্যা-এর বেশি হতে পারে না। ৭ সিটের গাড়িতে বাচ্চা ও ড্রাইভারসহ ৭ জন ই বসতে পারে। আমাদের দেশে যেমন জীপ গাড়ীতে ৯-১০ জন গাদাগাদি করে বসি, তেমনটি ওই সব দেশে সম্ভব না। তবে, মালয়েশিয়াতে দেখলাম ওটি তেমন সমস্যা না। অস্ট্রেলিয়াতে সব যাত্রীকে গাড়ীতে সীট বেল্ট বাঁধতে হয়। আর নির্ধারিত যাত্রীর চেয়ে অধিক যাত্রী নিলে জরিমানা তো হবেই, আর ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে পয়েন্ট কাটা যাবে। তাই আমি দেখি নি কাউকে অতিরিক্ত যাত্রী নিতে।
আমরা ¯েœা মাউন্টেইনস এ যাব ক্যানবেরা হয়ে। ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়া এর রাজধানী। মিজান এর বাসা থেকে ¯েœা মাউন্টেইনস এর দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলো মিটার। সময় লাগবে প্রায় ৬ ঘণ্টা। মিজান ভাই একা গাড়ী চালাল। পথে যেতে যেতে কেঙ্গারু চোখে পড়ল অনেক। কখন ও দেখলাম ঝোপের মধ্য থেকে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছে, কখন ও দেখলাম রাস্তা পার হতে গিয়ে চাপা পড়ে রাস্তার পাশে মৃত পড়ে আছে। অস্ট্রেলিয়াতে প্রাণী হত্যা আইনত দ-নীয় অপরাধ হলেও হাইওয়েতে গাড়ি চাপা পড়ে কেঙ্গারু মারা গেলে কোন জরিমানা বা দ- নেই। যা হোক, ভোর ৭ টায় কেনবেরা পৌঁছে আমরা পার্লামেন্ট ভবন দেখতে গেলাম। গাড়ি নিয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় ভবনের একবারে কাছে। কোন নিরাপত্তা বেষ্টনী চোখে পড়ল না আমাদেরকে আটকানোর জন্য। কেবল দু’এক জন পুলিশ দেখলাম ভবনের মূল দরজার বাইরে।
যা হোক, ¯েœা মাউন্টেইন এ পৌঁছে গাড়ী থেকে নেমে তুষার পাহাড়ের কাছে প্রচ- ঠা-া উপেক্ষা করে কোন রকমে আমরা পৌঁছলাম। প্রায় ১০-১৫ মিনিট বাচ্চারা স্লেজ নিয়ে তুষার পাহাড়ের উপর থেকে চালিয়ে নিচে নামতে থাকল একে একে। এত ঠা-া যে হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। আমরা সবাই গ্লাভস, কান টুপি, কয়েক স্তরের গরম কাপড় পরে গেলাম। কিন্তু তাতে কি কাজ হয়? ১০-১৫ মিনিট পরে হটাৎ আমার স্ত্রী মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল। তার চোখ-মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বাচ্চারা খুব ভয় পেয়ে গেল। আমার আর বড়মেয়ের অবস্থা ও অনেকটা খারাপ। ঠা-াতে আমাদের হাত পা অবশ হবার অবস্থা। ঠা-া ছোটগুলোকে কাবু করতে পারল না। তাকে কোন রকমে ধরাধরি করে এনে একটি শপিং মল-এর ফায়ার প্লেস-এর কাছে ১০-১৫ মিনিট বসিয়ে রাখলাম। তারপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে থাকল। বাচ্চারা একটু হতাশ হল বলে মনে হল। যা হোক, সেখানে কিছু হাল্কা খাবার খেয়ে সবাই গাড়ীতে ফেরত আসলাম।
ফেরার সময় ১০-১৫ মাইল পথে শুধু তুষার-এর পাহাড় দেখতে দেখতে আসলাম ।তুষার পাহাড় শেষ হলে একপাশে গাড়ী থামিয়ে ইলেকট্রিক চুলায় বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খিচুরি, ডিম গরম করে খেয়ে নিলাম। এত ঠা-া যে ভাল ভাবে গরম করার পর ও প্লেট এ নিতে নিতেই ঠা-া হয়ে যাচ্ছিল। মাইনাস ঠা-া আর দমকা বাতাসে ১ মিনিট ও গরম থাকছে না খাবার। কোন রকমে খেয়ে প্লেট বিন এ ফেলে আবার তাড়া হুড়ো করে গাড়িতে ঢুকে পড়লাম। এবার ফিরছি ভিন্ন পথে, ক্যানবেরা হয়ে না। ৪ ঘণ্টা-এর যাত্রাশেষে অবশেষে রাত দশটায় বাসায় পৌঁছলাম ।

লেখক : প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, বি জি সি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট