চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সবক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ চাই

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

এমন কোনো কোনো দিন রয়েছে যেগুলো জাতীয় জীবনে নিয়ে আসে যুগান্তর সম্ভাবনা। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে তেমন একটি দিন। মহান একুশে আমাদের জাতীয় অহংকার। বাঙ্গালির আত্মোপলব্ধি, জাতীয় অস্থিত্ব এবং সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত মান মর্যাদার প্রশ্নটিই মহান মাতৃভাষার লড়াইয়ে রূপান্তরিত হয়ে এক জাতিগত গর্ব ও গৌরবের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। মা ও মাটির সাথে যেমন নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মাতৃভাষার সাথেও থাকে তেমন সম্পর্ক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে বাঙ্গালি বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সালাম, জব্বার ও রফিকের মত অনেক বীর ভাষা সৈনিক বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। বাঙ্গালি জাতির গৌরব ও রক্তে রঞ্জিত বেদনার ইতিহাস ও শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) সাধারণ পরিষদে এ দিবসটিকে ‘‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে উদযাপনের একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে এ প্রস্তাবে বলা হয় ‘‘১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে মাতৃভাষার জন্য অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ এবং সেদিন যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার প্রস্তাব করা হচ্ছে।’’ মাতৃভাষার গৌরব ও মহিমা প্রতিষ্ঠার দীপ্ত প্রত্যয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে যে মহান আত্মত্যাগের নজির সৃষ্টি করেছিল প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে তাদের সেই মহান ত্যাগের মহিমা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পেল। আমাদের দেশে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন হয়েছে। আইন করার পরে যে সর্বস্তরে পুরোপুরি বাংলার প্রচলন হয়েছে সেটা বলতে পারিনা। উচ্চ আদালতে এবং ব্যাংকে পুরোপুুরি চালু হয়নি। আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রেও, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জটিলতা থেকে গেছে। আবার আমাদের বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্য পুস্তক খুললে ভুল বানান আর ভুল বাক্য দেখা যায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অধিকাংশ শিক্ষকেরই নেই প্রমিত বাংলা উচ্চারণ দক্ষতা। শিক্ষকেরা যখন ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেন তারাও তখন প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেন না।

কথা হচ্ছে যে ভাষার আঞ্চলিক রূপ আছে, প্রমিত রূপও আছে। আবার ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বাংলার চেয়ে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হয় বেশি। ব্যাংকে হিসাব খোলার ফরম, বিদ্যুৎ বিল, ওয়াসার পানির বিল ইত্যাদি ইংরেজিতে তৈরি হয়। এখন আমাদের করনীয় হল, জ্ঞানের সর্ব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে প্রয়াস চালনো। মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে তেমন ভাবে নিজেদের প্রস্তুত করা। জ্ঞানার্জন করতে হলে মানুষের অবশ্যই প্রয়োজনীয় ভাষা জ্ঞান থাকতে হবে। পড়াশুনার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের সঙ্গে, ভাষার চর্চাও যথেষ্ট পরিমান বৃদ্ধি পায়। প্রত্যেক মানুষের কাছে মাতৃভাষা সর্বাধিক প্রিয়। মায়ের প্রতি যেমন আন্তরিক শ্রদ্ধা, মাতৃভাষার প্রতিও গভীর অনুরাগ-শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালবাসা থাকে। মায়ের কাছ থেকে প্রথম এ ভাষা শিখা শুরু। তাই জগতে পদার্পন করার পর থেকে মাতৃভাষার সঙ্গে আমাদের আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। মায়ের বুলি দ্বারাই আমরা আমাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মায়া-মমতা ইত্যাদি মনের ভাব প্রকাশ করি। প্রকৃতপক্ষে ভাষা আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি।

প্রখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষের স্বভাবের মধ্যে যদি ভাষার বীজ না থাকত, তাহলে ভাষার অস্তিত্ব সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যেত না। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির সঙ্গে তার মধ্যে ভাষার বীজ রেখে দিয়েছেন। এদিক থেকে ভাষাকে মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব দান বলা যেতে পারে।’ পরিশেষে বলব, আমরা আমাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি বিশ্বের অন্য ভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাব। অন্য ভাষা শিখতে হবে কিন্তু সেটা আমাদের বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে নয়। এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা, শিশু শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা শব্দের উচ্চারণ ও বানান শিখে। অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও উচ্চতর শিক্ষ্যাব্যবস্থায় যথাযথভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। তবেই বাংলা ভাষা ও ভাষা দিবসের যথাযথ মূল্যায়ন হবে।

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট