চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সমুদ্র অর্থনীতি ও বাংলাদেশের বাঙ্কার খাত

মিজানুর রহমান মজুমদার

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

সমুদ্র অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনিমি’র মূল ভিত্তি হচ্ছে টেকসই সমুদ্র সম্পদ নীতিমালা। বিশে^র তিন ভাগ জল। বিশে^র দেশসমূহ তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত চাহিদা মেটাতে তাকিয়ে আছে সমুদ্রবক্ষে সঞ্চিত সম্পদ ও চলাচলের দিকে। ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাবার যোগান দিতে সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্রসম্পদ ও চলাচলরত জাহাজসমূহ বহুবিধ অবদান রেখে চলেছে। বছরে ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় সমুদ্র একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে ইতোমধ্যেই বিশ^জুড়ে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে। এর অন্যতম খাত ‘বাংকার’। জাহাজে জ¦ালানি, যন্ত্রাংশ, খাদ্য সরবরাহ, বর্জ্য অপসারণ বাংকারের আওতাধীন। সমুদ্রাঞ্চলের অনেক দেশ বাংকার সরবরাহের মাধ্যমে উন্নত দেশের কাতারে সামিল হয়েছে। সিঙ্গাপুর তার অন্যতম উদাহরণ। মেরিটাইম এন্ড পোর্ট অথোরটি (এমপিএ) এর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০০৮ সালে দেশটি জাহাজে জ¦ালানি সরবরাহ করে ৩৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন। যা ১৯১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন। এতে এটি প্রমাণিত হয় যে, জাহাজে জ¦ালানি সরবরাহের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির শক্ত ভিত পেয়েছে। বাংলাদেশও হতে পারে সিঙ্গাপুরের মতো বাংকার সরবরাহকারী দেশ। এতে দেশের রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থান হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্র অর্থনীতি নির্ভরতা বাড়াতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বাংলাদেশে বাংকার খাতটি পিছিয়ে আছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পোশাক শিল্পের পর বাংকার হতে পারে বৈদেশিক রাজস্ব আয়ের বড় খাত।
২০০৯ সালে লয়েডসের জরিপে আন্তর্জাতিক মানদ-ে বিশ্বের ১০০ শীর্ষ বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিল ৯৮তম। ২০১৯ সালে সূচক কমে ৬৩ তম স্থানে এসেছে। ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এ খাতে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতি বছর গড় আয় হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। অন্যান্য খাতের আয়ও বহুগুণ বেড়েছে। বন্দরের জলসীমার পরিধি ৭ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৪ নটিক্যাল মাইল। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সমুদ্রাঞ্চলকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এককথায় চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি বাংকার সরবরাহ। বরং কমেছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২-১৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ২ হাজার ১৩৬টি, মোংলা বন্দরে ৩৩৮টি জাহাজ এসেছে । যা ২০১৮-১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩ হাজার ৬৯৯টি। মোংলা বন্দরে এসেছে ১ হাজার ২৮০টি জাহাজ। অথাৎ বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি জাহাজ এসেছে।
এর মধ্যে ৩০ শতাংশ জ¦ালানি নিলে, বাংলাদেশ থেকে বছরে ১৪৯৩ জাহাজের জ¦ালানি সংগ্রহ করার কথা। প্রতিটি জাহাজ গড়ে ৪০০ মেট্রিক টন বাংকার নিয়ে থাকে। সে হিসাবে বাংলাদেশ বছরে আনুমানিক ৫ লাখ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন জ¦ালানি সমুদ্রগামী জাহাজে বিক্রি করতে পারে। যা দেশের অর্থনীতিকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০ নম্বর আদেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন। কেনা হয় বেশ কিছু জাহাজ। আধুনিকায়ন করা হয় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরকে। দেশি-বিদেশি জাহাজ চট্টগ্রামে আসতে থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি সীমিতভাবে জাহাজে জ্বালানি সরবরাহ করে। বন্দরসমূহে জাহাজ সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে যথাসময়ে জ্বালানি সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ক্রমে যমুনা অয়েল কোম্পানির বাংকার সরবরাহের চাহিদা কমতে থাকে। উল্লেখ, যে কোনো জাহাজকে বন্দরে ১ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা অতিরিক্ত অবস্থানের জন্য ১০ হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হয়। ফলে বেসরকারি পর্যায়ে চাহিদা বাড়তে থাকে।
এমতাবস্থায় বিপুল চাহিদার প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে নব্বই দশকে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সনাতন পদ্ধতিতে সমুদ্রগামী জাহাজে জ্বালানি সরবরাহ শুরু করে। ২০০১ সালের দিকে পরিধি বৃদ্ধি পায়। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। বেসরকারি বাংকার প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত জ¦ালানি সরবরাহ নিশ্চিত করায় দেশি-বিদেশী জাহাজ মালিকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আসতে থাকে প্রচুর বৈদেশিক রাজস্ব। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব আয়ের এ খাতটির প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর দেয়নি। সরকার বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করলেও তার বিপরীত চিত্র দেখা যায় জাহাজে বাংকার সরবরাহের ক্ষেত্রে।
সারা বিশ^ এখন সমুদ্র নির্ভর হয়ে পড়েছে। গাণিতিক হারে বেড়ে চলেছে জাহাজ চলাচল। এতে বেড়েছে দূষণের মাত্রা। বৈশ্বিক জলবায়ুতে এসেছে পরিবর্তন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ২০১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম সংস্থা (আইএমও) বিশ্বব্যাপী শিপিং লাইন ক্যারিয়ারগুলোর জন্য ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাজেশন (আইএমও) ২০২০ নীতিমালা প্রণয়ন করে। ‘আইএমও ২০২০’ নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিশ্বে চলাচলরত জাহাজগুলো থেকে নির্গমন হচ্ছে সাথে সরাসরি সম্পর্কিত সালফার অক্সাইড (এসওএস) এর মাত্রা হ্রাস করতে হবে। জাহাজে ব্যবহার করা জ¦ালানি থেকে নির্গত সালফার অক্সাইডের পরিমাণ ৩ দশমিক ৫০ এম.এম শতাংশ। যা বায়ুম-লকে ব্যাপকভাবে দুষিত করছে। এ দুষণের মাত্রা শুণ্য দশমিক ৫০ এম.এম শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। ২০০৫ সালে এ বিষয়ে প্রথম প্রস্তাব আনা হয়। ২০০৮ সালে এ প্রস্তাব পাশ হয়। পুনরায় ২০১৬ সালে তা গৃহীত হয় এবং ২০২০ সালের প্রথম দিন (১ জানুয়ারি) থেকে কার্যকরের সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সে অনুয়ায়ী পুরো বিশ^ জাহাজগুলোর জ্বালানি তেলে সালফারের সর্বোচ্চ মাত্রা শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত শুণ্য দশমিক ৫ শতাংশের হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও) নেই।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়া মেরিটাইম এন্ড লজিস্টিক ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিশ্বের উন্নত, মাঝারি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো সমুদ্রে চলাচলরত জাহাজগুলো থেকে নির্গত সালফার অক্সাইড সহনীয় মাত্রায় আনতে ঐক্যমত্যে এসেছে। বাংলাদেশও আইএমও নির্দেশনা মেনে চলার অঙ্গীকার করছে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রসঙ্গ তুলে ধরে আরো বলেছিলেন, রেল ও সড়ক পথের চেয়ে এ দেশে নৌপথের গুরুত্ব অনেক বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে এ দেশের নৌপথ বহুকাল ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ পথ সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অরগানাইজেশনের (আইএমও) সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যথাযথ নীতি অনুসরণ করে আসছে। সমুদ্রে দূষণ কমাতে জাহাজে শূন্য দশমিক ৫ মাত্রার সালফারযুক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার ও কম কার্বন নিঃসরণের বিষয়ে বাংলাদেশ খুবই সতর্ক রয়েছে।
আইএমও ২০২০ মানব স্বাস্থ্য ও সমুদ্র রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নীতিমালা জাতিসংঘের এসডিজিএসকেই সমর্থন করে। এসডিজির লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র নির্মূল করা, প্রাণির সুরক্ষা দেওয়া ও সবার জন্য সমৃদ্ধ জীবন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান করা।
আইএমও দশমিক শুন্য পাঁচ মাত্রার সালফার জ¦ালানি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এর সরল উত্তর হচ্ছে, জাহাজের বাংকার অয়েল বলতে প্রধানত ভারী তেলকেই বোঝায়। যা ক্রুড অয়েল থেকেই আসে। এ জ্বালানি দিয়েই ইঞ্জিন চলে। ক্রুড অয়েলে রয়েছে সালফার। জ্বলার পর নি:সরণ করে সালফার অক্সাইড। এটি স্বাস্ব্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। শ্বাসতন্ত্রের ও ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করে। সালফার অক্সাইডের কারণে এসিড বৃষ্টি হয়। এতে ফসল, জলজ প্রাণি ও বনাঞ্চল ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সমুদ্রের পানিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। জাহাজ থেকে নির্গত হওয়া সালফার অক্সাইডের মাত্রা সীমিতকরণ প্রক্রিয়া বন্দরনগরী ও উপকূলীয় এলাকার জনজীবনে স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যার ঝুঁকি যেমন শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতিবন্ধকতা, হৃদরোগ ও ফুসফুসের জটিলতা এড়াতে সহায়তা করবে। এসিড বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট শস্যহানি, কৃষি বনাঞ্চল ও সমুদ্র বিষয়ক ক্ষয়ক্ষতি কমে আসবে। কমে আসবে জাহাজ চলাচল রুটে বজ্রসহহ ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা ।
জাতিসংঘ কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে বাংলাদেশ আইএমও’র অংশ হিসেবে আইএমও ২০২০ নীতিমালা মানতে বাধ্য। বৈশ্বিক চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশকে জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর বিশ্বের ৬৪তম ব্যস্ত সমুদ্র বন্দর। জাহাজ মালিকরা বাংলাদেশের বন্দরসমূহে স্বল্প সালফার বিশিষ্ট জ্বালানি না পেলে জাহাজ পরিচালনায় তাদের সমস্যায় পড়তে হবে। বাংলাদেশ ‘নো বাংকারিং’ পোর্ট হিসেবে ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আশা কথা হচ্ছে, দেরিতে হলেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিদেশ থেকে শুন্য দশমিক ৫ মাত্রার সালফার হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও) আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উৎপাদনের নির্দেশনা দিয়েছে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ব তেল শোধনাগার ইষ্টার্ন রিফাইনারিকেও। বেশকিছু বেসরকারি বাংকার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকেকে ডিলারশীপ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি- বেসরকারি বাংকার সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ সুমদ্রগামী জাহাজসমূহে চাহিদা মোতাবেক শুন্য দশমিক ৫ মাত্রার জ¦ালানি সরবরাহ করতে না পারলে জাহাজসমূহ সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের বন্দরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাহাজ মালিকরা জাহাজ ভাড়া বাড়িয়ে দেবে। যা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে। বেড়ে যাবে আমদানি নির্ভর সব পণ্যের দাম। জনজীবনে দেখা দিবে অস্থিতিশীলতা। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় সময়ক্ষেপণ না করে সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

মিজানুর রহমান মজুমদার সভাপতি, বাংলাদেশ বাঙ্কার সাপ্লাইয়ার্স এসোসিয়েশন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট