নগরীর ফিরিঙ্গিবাজারের বাসিন্দা ৩৮ বছরের হাসান মিয়ার তিন দিন ধরে জ্বর। শরীরের জয়েন্টে এমন ব্যথা, মনে হচ্ছে ভেঙে যাচ্ছে। মাথা ধরে আছে, মুখে র্যাশ উঠেছে। স্থানীয় ফার্মেসি থেকে প্যারাসিটামল সেবনেও স্বস্তি মিলেনি। পরিবারের সদস্যরা একে মৌসুমী জ্বর হিসেবে ধরে নিয়ে গেল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। কর্তব্যরত চিকিৎসক ‘চিকুনগুনিয়া’ সন্দেহ করে নিশ্চিত হতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ নিতেই ঘটল বিপত্তি। খবর নিয়ে জানা গেল- সরকারি হাসপাতালে এই রোগের পরীক্ষার ব্যবস্থাই নেই।
হাসান মিয়া বলেন, ডাক্তার বললেন টেস্ট করতে। বাইরে বেসরকারি ল্যাবে গেলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লাগে। দিনমজুর মানুষ এতো টাকা পাবো কোথায়?
শুধু হাসান মিয়া নন, নগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে এমন শত শত রোগীর দেখা মিলছে। শরীরে জ্বর, জয়েন্টে তীব্র ব্যথা, শরীরে র্যাশ, প্রায় উপসর্গ এক। তবে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা না কোভিড, তা বোঝার উপায় নেই।
চলতি মৌসুমে কোভিড, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা- এ চার ধরনের রোগী বেড়েছে চট্টগ্রামে। এরমধ্যে প্রকোপ বেশি চিকুনগুনিয়ার। প্রতিদিনই নগরীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগীরা ভিড় করছেন জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা ও লালচে র্যাশ নিয়ে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আবদুর রব বলেন, ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া দুটোই এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। উপসর্গ এক হলেও চিকুনগুনিয়ায় জয়েন্ট ফুলে যায়, ডেঙ্গুতে তেমন হয় না। কিন্তু পরীক্ষা না থাকলে রোগ বোঝা যায় না।
দুঃখজনক হলেও সত্য, কোভিড কিংবা ডেঙ্গু শনাক্তে ব্যবস্থা থাকলেও চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া শনাক্তে সরকারি কোনো ল্যাবে পরীক্ষার ব্যবস্থাই নেই। যার কারণে অনেকটাই উপসর্গ দেখে ‘অনুমান’ নির্ভর চিকিৎসা চলছে। শুধুমাত্র বেসরকারি কয়েকটি ল্যাবে এন্টিবডি পরীক্ষা হচ্ছে। আবার খরচও অনেক। বেসরকারি ল্যাবগুলোতে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষায় গড়ে দেড় থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। দিনমজুর, নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য এই খরচ চালানো অসম্ভব।
বেসরকারি পর্যায়ে এপিক হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক সপ্তাহের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৪৪ জনের চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫ জনের ফলাফল পজিটিভ পাওয়া গেছে। যা প্রায় ২৬ শতাংশ। তবে চিকিৎসকদের ধারণা- চলতি বছর চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব অন্য রোগের চেয়ে অনেক বেশি।
চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। কারণ, অধিকাংশ রোগী পরীক্ষার খরচ বহন করতে না পেরে উপসর্গ নিয়েই ঘরে অবস্থান করছেন।
আইসিডিডিআরবি’র জুন মাসের তথ্য বলছে, তাদের আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় ৮২ শতাংশ নমুনায় চিকুনগুনিয়া ধরা পড়েছে। অথচ চট্টগ্রাম থেকে এখনো কোনো সরকারি নমুনা পাঠানো হয়নি। ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি স্বাস্থ্য বিভাগের অজানাই রয়ে গেছে।
চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন, দ্রুত পরীক্ষা চালু করা না হলে পরিস্থিতি ২০১৭ সালের মতো ভয়াবহ হতে পারে। ওই বছর দেশে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ফের আক্রান্ত হয় ৬৭ জন। এবার সেই আতঙ্কই নতুন করে ফিরে এসেছে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চমেক হাসপাতাল এবং নগরীর বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, উপসর্গের কারণে চিকুনগুনিয়া সন্দেহে অনেক রোগী আসলেও সরকারি পর্যায়ে কোনো পরীক্ষা নেই। ফলে একদিকে রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব, অন্যদিকে প্রকৃত সংক্রমণ চিত্রও সরকারের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দীন বলেন, সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত এলে আমরাও চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করতে পারব। যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান, তাই সরকারের সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন কিছু করার সুযোগ নেই।
চিকিৎসকদের পরামর্শ: উপসর্গ একই হওয়ায় অনেক সময় ভুল চিকিৎসা হচ্ছে। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধ না খাওয়ার পরামর্শ দিলেও অনেকেই এন্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক খেয়ে পরিস্থিতি খারাপ করে ফেলছেন।
চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দীন চৌধুরী বলেন, এ মৌসুমে একসঙ্গে এত রোগের প্রকোপ আগে কখনও দেখা যায়নি। উপসর্গ প্রায় এক হওয়ায় রোগ নির্ণয় ছাড়া ওষুধ দেওয়া বিপজ্জনক। এর ফলে অনেকে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া-ইনফ্লুয়েঞ্জা একসঙ্গে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই পরীক্ষা ছাড়া ওষুধ নয়।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বর্ষার পানি জমে থাকায় এডিস মশার প্রজনন বাড়ছে। এতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি বাড়বে। তাই সবার সতর্ক থাকা জরুরি।
পূর্বকোণ/ইবনুর