৫ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে আমিন জুট মিল। এতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কারখানার মেশিন ও যন্ত্রাংশ। জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে দেশের প্রাচীনতম কারখানাটি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় জায়গা-জমির দখল ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের ১ জুলাই দেশের পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এসময় বন্ধ হয়ে যায় দেশের পুরোনো পাটকল আমিন জুট মিলও। সেই হিসাবে ৫ বছর ধরে বন্ধ পড়ে রয়েছে কারখানাটি।
কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের উদাসীনতা ও অবহেলায় দেশের লাভজনক পাটকলগুলো ধীরে ধীরে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। লোকসানের ঘানি টানতে টানতে রুগ্ন ও ‘মৃত’ শিল্পে পরিণত হয়।
আমিন জুট মিল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আরিফুর রহমান বলেন, সোনালি আঁশ হিসেবে খ্যাত পাটশিল্প ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারী শিল্প। পাটকলগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করা হলে দেশের হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মিল কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, এখনো ৪৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। এছাড়াও রয়েছেন আনসার সদস্যসহ অনেক সিকিউরিটি। প্রতি মাসে তাদের বেতন-ভাতা হিসেবে অন্তত ৬০ লাখ টাকা গুনতে হচ্ছে সরকারকে। ৫ বছরে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা গুনতে হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে ধার-দেনা, ঋণ ও টানাটানি করে জোগাড় করতে হচ্ছে এসব টাকা।
মিল কর্মকর্তারা জানান, পুরোনো স্ক্র্যাপ বিক্রি, ক্লাব-ক্যান্টিন ও দোকান ভাড়া দিয়ে অর্থের কিছুটা সংকুলান করা হচ্ছে। বড় অঙ্কের টাকা সরকার থেকে ধার-দেনা ও ঋণ হিসেবে নেওয়া হচ্ছে।
আমিন জুট মিলের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূর্বকোণকে বলেন, গুদামসহ কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিয়ে চলতে হচ্ছে। অনেক উচ্চশিক্ষিত তরুণ কর্মকর্তা কাজ-কর্ম ছাড়া বসে বসে বেতন-ভাতা গুনচ্ছেন। হতাশা ও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন তারা। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে তাদের আত্মীকরণ করা হলে সরকার লাভবান হবে।
চ্যালেঞ্জ সম্পদ রক্ষা: কর্মকর্তারা জানান, ১৯৫৪ সালে ৮১ একর জমির উপর আমিন জুট মিল গড়ে ওঠে। জুট মিলের সাবেক শ্রমিক ও পাট শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় সহ যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মান্নান বলেন, ১৭১ একর সম্পদ ছিল। বেশির ভাগ সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। বন্ধ থাকার সুযোগে ও দেশের পট-পরিবর্তনের পর প্রভাবশালীরা সম্পত্তি দখলের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সম্পদ রক্ষা ও বেদখল হওয়া সম্পদ উদ্ধার করা হলে অনেক আয়বর্ধক প্রকল্প নেওয়া যাবে। এতে সরকার যেমন বড় লাভবান হবে, বিপুল পরিমাণ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
কার স্বার্থে পাটশিল্প ধ্বংস: পাটকল শ্রমিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দাবি করেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় গুটিকয়েক শিল্পপতি ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্বার্থ রক্ষায় পাটশিল্প পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। বিশেষ করে গত সরকারের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী পাটশিল্প ধ্বংসে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন। দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে পাটের কাঁচামাল ভারতে রপ্তানি করা হয়। এভাবে দেশীয় শিল্প ধীরে ধীরে ধ্বংস করে পাটকলের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধ করার সময় সরকার সীমিত আকারে চালু রাখার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীসময়ে সেই আশ্বাস আর বাস্তবায়ন করেনি।
পাট শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় সহ যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মান্নান বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। জুটমিলগুলোর লিজ বাতিল ও সংস্কার করে রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধ মিল চালু করা এবং শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করার দাবি করেছি।
জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা: ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের নাগরিক ‘আমিন সাহেব’ মিলটি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত আমিন জুট মিলের বেশিরভাগ মেশিনই সেকালের। প্রায় বন্ধ ও অচল হয়ে যেত। জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। বর্তমানে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অধিকাংশ মেশিন, যন্ত্রাংশ মরিচা ধরেছে। নষ্ট ও অকেজো হয়ে গেছে।
আমিন জুট মিলে উৎপাদিত কার্পেট, জায়নামাজ, চর্টের বস্তা বিখ্যাত ছিল। বড় ক্রেতা ছিল ইরান। আমিন জুট মিলের কার্পেটেই ঢাকা-বাগদাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল মধুর। ইরাক-ইরান যুদ্ধের পর সেই বাজার হারিয়ে যায়। নতুন কোনো বাজার আর সৃষ্টি করা যায়নি। এছাড়াও আমিন জুট মিলে তৈরি কম্বল ও কাপড়ও বিদেশে রপ্তানি করা হতো।
শ্রমিক-কর্মচারীরা জানান, এক সময় ভারত বাংলাদেশ থেকে চটের বস্তা আমদানি করতো। পরে তা বন্ধ করে পাটের কাঁচামাল আমদানি শুরু করে। এতে দেশীয় শিল্প ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হয়ে পড়ে। গত সপ্তাহে ভারত স্থলপথে পাটের কাঁচামাল আমদানি বন্ধ ঘোষণা করে। এতে পাটশিল্প ও পাট চাষিদের শেষ প্রদীপটি এখন নিভু নিভু অবস্থা।
পূর্বকোণ/ইবনুর