চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০২৫

সর্বশেষ:

হালিশহরের দুঃখ ভাঙা রাস্তার দীর্ঘশ্বাস
চট্টগ্রামের হালিশহরের বি ব্লকের একটি সড়কের চিত্র

হালিশহরের দুঃখ ভাঙা রাস্তার দীর্ঘশ্বাস

তাসনীম হাসান

২ জুলাই, ২০২৫ | ১২:৫১ অপরাহ্ণ

চীনের দুঃখ হোয়াংহো নদী, হালিশহরের দুঃখ ভাঙা রাস্তা! চীন যেমন হাজার বছর ধরে হোয়াংহোর ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত, তেমনি হালিশহরের মানুষ বছরের পর বছর ভুগছেন এক অনিরাময়যোগ্য ব্যাধিতে- ‘পথদুর্ভোগ।’ পোর্ট কানেকটিং সড়ক আর আগ্রাবাদ এক্সেস রোড সংস্কারের ‘প্রসববেদনা’ এই অঞ্চলের মানুষকে অর্ধযুগ ধরে দিয়েছে নরকযন্ত্রণা। এখন পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্পের জন্য হালিশহরের মূল সড়ক থেকে অলিগলি, সবটার বুক চিরেই যেন ওপেন হার্ট সার্জারি করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এরপর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সেগুলো মেরামত না করায় বর্ষা মৌসুমে পুরো এলাকা যেন রূপ নিয়েছে যুদ্ধবিদ্ধস্ত কোন জনপদে।

 

চট্টগ্রাম মহানগরের পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা স্থাপন-প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২২ সালের শুরুতে। প্রকল্পের অধীনে নগরীর সড়কগুলো কাটতে শুরু করে ওয়াসা। হালিশহরের সড়কগুলোও কাটা হয় তখন। স্বাভাবিকভাবে সড়ক কাটার পর প্রাথমিকভাবে সংস্কার করে দেয় ওয়াসা। আর একেবারে মেরামত করে পিচঢালাইয়ের কাজ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। এজন্য দুই সংস্থার মধ্যে চুক্তিও হয়। কিন্তু কাটার পর সড়কগুলো আর সংস্কার করা হয়নি। শুষ্ক মৌসুমে কিছুটা ভালো থাকলেও বর্ষা শুরু হতেই সড়কগুলো রূপ নিয়েছে ছোটখাটো খালে।

 

হালিশহরে একদিন: হালিশহর বি-ব্লকের ৩ নম্বর লেনের সড়ক ধরে সামনে এগোতেই থমকে দাঁড়াতে হয়। সড়ক আছে বটে, কিন্তু কোথাও পিচের অস্তিত্ব নেই। যতই সামনে এগোবে, ততই যেন ওঁৎ পেতে আছে খানাখন্দে ভরা পথের দুর্দশা। যন্ত্রণার এখানেই শেষ নয়, দু’পাশের নালা থেকে আবর্জনা তুলে রাখা হয়েছে সড়কের উপরে। একদিকে ভাঙা সড়ক, অন্যদিকে আবর্জনার দুর্গন্ধ। এই ঘোর বর্ষায় প্রতিদিনের যাতায়াত, শিশুর স্কুলযাত্রা, অসুস্থদের হাসপাতালে পৌঁছানো যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘দুস্তর পারাবার।’

 

সেখানে কথা হয় তরুণ উদ্যোক্তা ফাহাদ চৌধুরী দিপুর সঙ্গে। তিনি বলেন, পোর্ট কানেকটিং সড়ক আর আগ্রাবাদ এক্সেস রোড বহু বছর ধরে সংস্কারকাজের জন্য অচল থাকায় আমরা ওই সময়ে হালিশহর থেকে তেমন একটা বেরোতে পারিনি। এখন সড়ক দুটি সংস্কার হওয়ার পরও বেরোতে পারছি না। কারণ এখন হালিশহরের অভ্যন্তরের সড়কগুলো ভাঙা হওয়ার কারণে একপ্রকার ঘরবন্দী হয়ে আছি। ভাঙা সড়কের যন্ত্রণা যেন আমাদের কপালের লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

বি ব্লকের এস ক্লাব মোড়ে পাওয়া গেলো মোহাম্মদ আলম নামের আরেক যুবককে। একটি চায়ের দোকানে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন তিনি। আলম বলেন, আমি ব্যাকপেইনের (পিঠের ব্যথা) রোগী। কদিন আগে ব্যাটারিচালিত রিকশা করে যাওয়ার সময় চাকা খানাখন্দে পড়ায় এমন ঝাঁকুনি খেয়েছি.., তিনদিন বিছানায় ছিলাম। সেই ধকল কাটিয়ে এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি।

 

বি ব্লকের পাশাপাশি এইচ ব্লক ও জি ব্লকের সড়কগুলোরও একই হাল। তবে এখানকার সড়কগুলোতে কিছুটা ইট-সুরকির দেখা মিললেও তালতলা মোড়, আব্বাস পাড়া, ফুল চৌধুরী পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক পরিণত হয়েছে কাদামাটিতে।

 

হালিশহরে বেশ কয়েকবছর ধরে রিকশা চালান শাহাব উদ্দিন। এক বছর আগে তিনি পায়েচালিত রিকশা চালাতেন। তবে রাস্তা ভাঙার কারণে তার গাড়িটি একাধিকবার খানাখন্দে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা ভাড়ায় চালাচ্ছেন তিনি। শাহাব বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা হওয়ায় কিছুটা হলেও চালাতে পারছি; পায়েচালিত রিকশা চালানোর কোন সুযোগই নেই এখানকার সড়কগুলোতে।

 

ওই সড়ক দিয়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াত রয়েছে। স্কুলফেরত বেশ কয়েকজনকে পাওয়া গেলো। তাদের সবার একই কথা, ‘একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তাজুড়ে জমে থাকে পানি। যান চলাচল তখন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। খানাখন্দে ভরা সড়ক দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ি।’

 

বন্ধ দোকানপাট: আগ্রাবাদ এক্সেস রোড ও পোর্ট কানেকটিং সড়কের সংস্কারকাজের জন্য ওই অঞ্চলের হাজারো ব্যবসায়ীর পথে বসার দশা হয়েছিল। এবার সেই চিত্র হালিশহরের ভেতরেও। এখানে ভাঙা সড়কের কারণে বন্ধ রয়েছে শতাধিক দোকান। অনেকেই দোকান ছাড়ার কথাও জানিয়েছেন। আশপাশের প্রায় সব ভবনে দেখা গেছে বাসা ভাড়া দেওয়ার ঘোষণা সংবলিত বিজ্ঞাপন।

 

বি ব্লকে বন্ধ থাকা দোকানের একটি ‘মেসার্স আলহাজ গোলাম মাওলা ট্রেডার্স’। ক্রোকারিজসামগ্রী বিক্রির ওই প্রতিষ্ঠান বহুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের মালিক আশরাফ উদ্দিন বলেন, বহু বছর ধরে আমাদের ব্যবসা নেই। বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি উঠে যায়, আর সেই পানি ঢুকে পড়ে দোকানে। এর মধ্যে আবার নালার ময়লা-আবর্জনা তুলে রাখা হয়েছে। আমাদের কারও ব্যবসা নেই।

 

একই কারণে বন্ধ ছিল আকবর স্টোর নামের আরেকটি মুদি দোকান। দোকানি আকবরকে ফোন করা হলে বলেন, দোকান খুলে কী লাভ? ভাঙা রাস্তার কারণে ক্রেতা তো দোকান পর্যন্তই আসতে পারে না।

 

৩০ বছর ধরে টেইলার্সের দোকান করছেন মোহাম্মদ কামাল। দৈনিক পূর্বকোণকে এই প্রবীণ বলেন, ঈদ গেলো, কোরবান গেলো। এই জীবনে ব্যবসার এমন খারাপ পরিস্থিতি যায়নি। এর জন্য পুরোটাই দায়ী ভাঙা সড়ক।

 

একটি ভবনের নিরাপত্তারক্ষী আবুল কালাম বলেন, ভাঙা সড়ক হওয়ায় এখানকার বেশিরভাগ ভবনে প্রায়সময় বাসা খালি থাকছে। বর্ষা মৌসুমে সেটি আরও বেড়েছে। সড়কের কারণে যাতায়াতব্যবস্থা একেবারেই নাজুক। মানুষ থাকবেই বা কেন?

 

দুই সংস্থার বক্তব্য: জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, হালিশহরের সড়কগুলো সংস্কার না হওয়ায় আমরা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছি। কারণ সিটি কর্পোরেশন থেকে অনুমতি নেওয়ার পর, তাদের চাহিদা অনুযায়ী বিল পরিশোধের পর আমরা সড়কগুলো কেটে পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ করেছি। কিন্তু আমাদের কাজ শেষের এত বছর কেটে গেলেও সড়কগুলো সংস্কার করা হয়নি। সংস্কারের কাজ আমাদের না হলেও মানুষজন এখন দোষারোপ করছে আমাদের।

 

তবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম দাবি করেন, ওয়াসা এখনও সব সড়ক তাদের বুঝিয়ে দেয়নি। তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘ওয়াসা কয়েকটি সড়ক বুঝিয়ে দিয়েছে, কয়েকটি দেয়নি। এগুলো নিয়ে আমরা খুবই যন্ত্রণায় আছি। মানুষজন আমাদের ফোন দিয়ে সমস্যার কথা জানাচ্ছে। কিন্তু এখন বর্ষা মৌসুম হওয়ায় সংস্কারকাজও করা সম্ভব নয়।’

 

দুই সংস্থার ঠেলাঠেলিতে মুমূর্ষু সড়কগুলো কবে ‘জীবন’ ফিরে পাবে, সেই ক্লান্তিহীন অপেক্ষায় এখন হালিশহরের হাজারো বাসিন্দা।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট