বাবার দেখানো পথে সাত সন্তান; তারা চট্টগ্রামে বিএনপির তরুণ রাজনীতিবিদ। তাদের কারও কারও বাবা ছিলেন একসময়ের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। আবার কারও বাবা বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, ছিলেন একসময়ের প্রভাবশালী মন্ত্রীও।
বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাদের সন্তানেরা বর্তমানে চট্টগ্রামে রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্তসময় পার করছেন। কেন্দ্র ও জেলা কমিটির নেতৃত্বেও আছেন তাদের কেউ কেউ। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমপক্ষে চট্টগ্রামের ৫টি সংসদীয় আসনে বিএনপি থেকে তাদের প্রার্থী হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।
সাত সন্তানের প্রত্যেকের বাবা নিজ নিজ আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, একাধিকবার হন সরকারের মন্ত্রী এবং মেয়রও। কিন্তু তাদের অনেকেই আজ নেই। মৃত্যুর আগে রাজনীতির মাঠে সরব ছিলেন, ছিলেন দলের গুরুত্বপূর্ণ পদেও। তাই বাবার রেখে যাওয়া আসনে সন্তানদের এবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার সুযোগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমানে তারা সক্রিয় আছেন মাঠে-ময়দানে।
আবার যাদের বাবা বেঁচে আছেন, তাদের সন্তানেরাও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন রাজনীতির মাঠে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিগত সরকারের আমলে আন্দোলন-সংগ্রামেও জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন। তারা বাবার মতো দায়িত্ব পালন করছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে। রাজনীতির বাইরে সক্রিয় আছেন সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেও।
বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা সন্তানেরা হলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য মরহুম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছেলে ইসরাফিল খসরু, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মরহুম আবদুল্লাহ আল নোমানের ছেলে সাঈদ আল নোমান, বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের ছেলে ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মরহুম জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে জহিরুল ইসলাম চৌধুরী আলমগীর ও মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা এবং জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ মরহুম সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, চট্টগ্রামের ৫টি আসনে বিএনপি থেকে তাদের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই উজ্জ্বল হচ্ছে।
চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী ও বায়েজিদ-আংশিক): এ আসনে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে সরব রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের ছেলে। মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। তিনি হাটহাজারী উপজেলা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম উত্তর ও মহানগর বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। হয়েছেন মন্ত্রী ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। দায়িত্ব পালন করেছেন রাষ্ট্রদূতেরও।
বর্তমানে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। বাবার রাজনীতির পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছেলে ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। রাজনীতিতে হাটহাজারীর সর্বত্র তার সক্রিয় অবস্থান রয়েছে। তিনি এবার হাটহাজারী আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, জন্মসূত্রে আমি রাজনীতিবিদের সন্তান। তবে তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আজকের এ অবস্থানে এসেছি। বিগত ১৭ বছর দলের আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে সক্রিয় ছিলাম। একইসাথে হাটহাজারীতে বিএনপির শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছি। তাই বিএনপির একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে হাটহাজারীর মানুষ আমাকে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায়। দল যদি আমাকে মনোনয়ন দেয় আমি নির্বাচন করবো ইনশাআল্লাহ।
একই আসনে সাবেক হুইপ মরহুম সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাও বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী। বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাবেক উপদেষ্টা ও সংসদের সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম স্বাধীনতা পরবর্তী ১০টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচবার জয়লাভ করেছিলেন। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তিনি হাটহাজারী থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৯১, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, একই বছর ১২ জুন এবং ২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তার জীবদ্দশায় পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতির মাঠে নামেন মেয়ে ব্যরিস্টার শাকিলা ফারজানা। তিনি উত্তর জেলা বিএনপি এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। বাবার মৃত্যুর পর রাজনীতির মাঠে তিনি আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। হাটহাজারীতে দলের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনিও বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এ প্রসঙ্গে দৈনিক পূর্বকোণকে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা বলেন, আমার বাবা সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং এ আসনে টানা পাঁচবার সংসদ সদস্য ছিলেন। আমি তার উত্তরসূরি হিসেবে এ আসনে নির্বাচন করতে চাই। দলের চেয়ারপার্সন আমাকে মনোনয়ন দিলে আমি অবশ্যই নির্বাচন করবো।
চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া): এ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দৌড়ে আছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী। তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য মরহুম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সন্তান। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিগত ৮০ দশকে জাতীয় পার্টি থেকে মন্ত্রী ও চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি আসন থেকে ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার মৃত্যুর পর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী রাঙ্গুনিয়া আসনে রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে বেশ তৎপর রয়েছেন। এছাড়াও বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-পাহাড়তলী-হালিশহর-খুলশী): চট্টগ্রাম-১০ ও চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর, পতেঙ্গা, ডবলমুরিং, ইপিজেড ও সদরঘাট) আসনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চাইতে পারেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। চট্টগ্রাম-১১ আসন থেকে বিএনপি যে পাঁচবার জয়লাভ করে তার চারবারই বিজয়ী হন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি ১৯৯১ সালে উপনির্বাচনে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, একই বছর ১২ জুন এবং ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
বিগত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে জোরালো ভূমিকা পালন করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। জাতীয় রাজনীতি নিয়ে তিনি ঢাকায় সবসময় ব্যস্ত থাকেন। এ অবস্থায় তার ছেলে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ইসরাফিল খসরু দীর্ঘদিন ধরে এ দুই আসনে রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রয়েছেন। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসরাফিল খসরুর মনোনয়ন চাওয়ার কোন চিন্তা নেই। তবে দল তাকে প্রার্থী করলে তিনি নির্বাচন করবেন।
এদিকে, কোতোয়ালী সদর আসন থেকে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে তিনি নির্বাচনের পর দুই দফায় বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও হন। তিনি চট্টগ্রাম-১০ আসনে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে প্রার্থী হন। চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুর পর ছেলে তরুণ রাজনীতিবিদ সাঈদ আল নোমান বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চট্টগ্রাম-১০ আসনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আগামী নির্বাচনে এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থিতার তালিকায় তার নামও শোনা যাচ্ছে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পাট শ্রমিক দলের সভাপতি।
জানতে চাইলে দৈনিক পূর্বকোণকে তিনি বলেন, মনোনয়ন পাওয়া বা সংসদ সদস্য হওয়া কখনই আমার একার সিদ্ধান্ত নয়; এটা জনগণের ভালোবাসা, আস্থা ও দলের সিদ্ধান্ত। আমি শুধু প্রস্তুত থাকি সেবা করার জন্য; বাকিটা ঠিক করবে জনগণ এবং আমার দল।
তিনি বলেন, আমার রাজনীতির শুরু বাবার পাশে থেকেই। ১৯৯১ সালের নির্বাচনেই আমি সক্রিয়ভাবে তার পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেই। এরপর ১৯৯৬ সাল থেকে টানা চারটি নির্বাচনে আমি তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছি। বাবার পাশে থেকে আমি শুধু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাই অর্জন করিনি, শিখেছি কীভাবে মানুষের পাশে থাকতে হয়, কীভাবে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হয়।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী): এ আসনে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী জিতেছেন টানা চারবার। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ ও একই বছর ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচনেও জয়লাভ করেন। এরপর ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচন ও ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনেও জয়ী হন তিনি।
তার মৃত্যুর পর রাজনীতির মাঠে সক্রিয় রয়েছেন দুই সন্তান দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা ও সদস্য জহিরুল ইসলাম চৌধুরী আলমগীর। এর মধ্যে রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে বেশি সক্রিয় মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা। বাবার আসনে মনোনয়ন দৌড়ে তিনি অনেকটা এগিয়ে আছেন বলে জানিয়েছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।
পূর্বকোণ/পিআর