চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫

সর্বশেষ:

অতি ক্ষুদ্র বড়িতেই ‘শেষ’ জীবন-পরিবার!
ফাইল ছবি

অতি ক্ষুদ্র বড়িতেই ‘শেষ’ জীবন-পরিবার!

তাসনীম হাসান

২৬ জুন, ২০২৫ | ২:০৬ অপরাহ্ণ

দেখতে গোলাকৃতি। গায়ের রঙ লালচে কিংবা গোলাপি। মেথাম্ফেটামিন এবং ক্যাফেইনের সংমিশ্রণে তৈরি বড়িটির ওজনও একেবারেই সামান্য। প্রতিটির গড় ওজন সাধারণত ৯০ থেকে ১২০ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ ০ দশমিক ১ গ্রামের আশপাশে। ছোট্ট সেই মাদকটিই হয়ে ওঠেছে এক সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। উঠতি বয়সের তরুণেরা এই মাদক সেবনের শুরুটা করেন কৌতূহল কিংবা বন্ধুদের চাপে। আর তাদের শেষটা হয় কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে, কখনো নির্মম মৃত্যুতে, কখনোবা অন্যদের জীবন নিয়ে। বড়িটির নাম কি আর বলতে হয়-ইয়াবা!

 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় ৩২ ধরনের মাদক সেবন চলে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়-মাদক হলো ইয়াবা। ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে প্রবেশের মধ্যে দিয়ে এর ভয়াল থাবার যাত্রা শুরু। এরপর থেকে সেটি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মিয়ানমারে তৈরি হওয়া এই মাদকদ্রব্যটি দেশের দক্ষিণ পূর্বের নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসে। এরপর ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।

 

বাংলাদেশে সাধারণত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্টগার্ড মাদকদ্রব্য জব্দ করে আসছে। তাদের জব্দ করা মাদকের মধ্যে সবচেয়ে যেটি পাওয়া যাচ্ছে সেটি হলো ইয়াবা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে এই পাঁচ সংস্থার গত ১০ বছরের মাদক উদ্ধারের তথ্য দেওয়া আছে। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত-এই দশ বছরে ৩৩ কোটি ৭৬ লাখ ৭৫ হাজার ৬৫৪টি ইয়াবা বড়ি জব্দ করেছে সংস্থাগুলো। এরমধ্যে ২০১৫ সালে ২ কোটি ১৭ লাখ ৮ হাজার ৫৮১টি, ২০১৬ সালে ২৯ লাখ ৪৫ হাজার ১৭৮টি, ২০১৭ সালে ৪ কোটি ৭৯ হাজার ৪৪৩টি, ২০১৮ সালে ৫৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৮টি, ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৬ হাজার ৩২৮টি, ২০২০ সালে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার ১৭টি, ২০২১ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৫টি, ২০২২ সালে কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯টি, ২০২৩ সালে ৪ কোটি ২৯ লাখ ৭৭ হাজার ২১৯টি ও ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে ১ কোটি ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ২১৯টি ইয়াবা জব্দ করা হয়। এরপর আর তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি।

 

উদ্ধার হওয়া ইয়াবার বেশিরভাগই বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে। তবে চট্টগ্রামের পরিপূর্ণ তালিকাটা পাওয়া যায়নি। বেসরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) হিসেব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে মাদকসেবী প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে এক কোটি মাদকাসক্ত এবং বাকি ৫০ লাখ মাঝে মধ্যে মাদক সেবন করেন। মাদকাসক্তদের ৮০ শতাংশই কিশোর-তরুণ। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তাদের প্রায় সবাই ইয়াবাতে আসক্ত। এছাড়া হেরোইন, ফেনসিডিল ও গাঁজা সেবন করছেন অনেক মাদকসেবী।

 

সংস্থাটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাদকাসক্তদের ৩০ শতাংশ শুধু নেশার খরচ জোগাতে অপরাধ ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। আর দেশে যত রকমের অপরাধের ঘটনা ঘটছে তার বড় অংশই ঘটছে মাদকের কারণে। মাদক সেবনের টাকা জোগানো ও কেনাবেচা নিয়ে সংঘটিত অপরাধ এখন সর্বত্র। ইয়াবার টাকা জোগাতে মাদকসেবীরা মা-বাবা, ভাই-বোনের মতো আপনজনকে খুন করতেও দ্বিধা করছে না।

 

গত মাসেই চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ‘ইয়াবা আসক্ত’ ছোট ভাইয়ের হাতে খুন হন প্রবাস ফেরত বড় ভাই। ওই ঘটনার পর পুলিশ জানিয়েছিল, রাতভর ইয়াবা সেবন করে দিনভর ঘুমাতো মো. জাহেদ ও তাঁর স্ত্রী তাসমিন বিনতে আসলাম ওহি। ছোট ভাই ও তাঁর স্ত্রীকে বারবার ইয়াবা সেবন করতে বাধা দিতেন বড় ভাই মো. সাহেদ। এতে বিরক্ত হয়ে স্বামী স্ত্রী মিলে খুন করেন সাহেদকে। এর আগে গত বছরের জুনে নগরীর পাহাড়তলীতে ইয়াবা কেনার টাকা না পেয়ে মা রিনা আক্তার চন্দনাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে খুন করেছিলেন ওমর ফারুক নামের এক পাষণ্ড। এই চিত্র শুধু চট্টগ্রামে নয়, সারাদেশেই।

 

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়াবা আসক্তির বহু কারণের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় অন্যতম। মাদকটি খুবই সহজলভ্য। দামও হাতের নাগালে। সেজন্য খুব সহজেই এটিতে আসক্ত হচ্ছে কিশোর-তরুণেরা। কিন্তু এই মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের অনেকেই জানেন না।

 

বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় মাসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল তাঁর একবার বলেছিলেন, ‘আমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ওজন ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ গ্রাম। ইয়াবা সেবনে এই ওজন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন কেউ যদি এক থেকে দুই বছর নিয়মিত ইয়াবা সেবন করে, তার মস্তিষ্কের ওজন ১০০০ গ্রামে নেমে আসে। এটা ভয়ংকর ক্ষতি। সুতরাং সতর্ক থাকতে হবে, দূরে থাকতে হবে।’

 

দুই কারণে দেশে ইয়াবার প্রসার বাড়ছে বলে মনে করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন মোল্লা। তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ইয়াবা আমাদের পাশের দুই দেশ ভারত-মিয়ানমারে উৎপাদন হয়। আর দুই দেশের মাদক ব্যবসায়ীরাই কিনা আমাদের দেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী সেটি ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ কারণে আমাদের বিপথগামী তরুণদের হাতেও সেটি চলছে। আর তরুণদের মধ্যে একটা মিথ (লোককথা) ছড়িয়ে পড়েছে, সেটি হলো তারা মনে করেন ইয়াবা সেবনে শক্তি বাড়ে। এজন্য অনেকেই কৌতূহলে সেটি সেবন করে। কিন্তু এই ধারণা পুরোটাই ভুল ধারণা। ইয়াবা সেবনে শক্তি বাড়ে না, জীবন ক্ষয় হয়।’

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট