জীবনে সবচেয়ে বেশি আড়ালে থাকা মানুষটার নাম বাবা। সংসারের জন্য নিঃশব্দে লড়ে যাওয়া, ত্যাগ-পরিশ্রম আর আদরের সেই মানুষটাকে নিয়ে কখনো খুব বেশি বলা হয় না। তবে বাবা দিবস এলে না বলা কথাগুলো যেন একটু একটু করে ভেসে ওঠে। সফল সন্তানরা তাদের জীবনের অনুপ্রেরণা সেই বাবাকে মনে করেন যিনি সাফল্যের মঞ্চে না দাঁড়িয়ে সন্তানদের পেছনে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তিনজন সফল সন্তান লিখেছেন, তিন রকম জীবনের গল্প।
কেউ বাবার বলা ‘ফার্স্ট হইতে হবে’ কথাকে জীবনের পাঠশালা বানিয়েছেন, কেউ শিখেছেন বিনয়ের অনুশাসন, আবার কেউ বাবার মতো সমাজের জন্য বাঁচতে শিখেছেন। সফল তিন সন্তানের কথায় তাদের বাবার গল্প তুলে ধরা হলো।
‘কখনো অহংকার করতে নেই’
ডা. রেশমা শারমিন
স্ত্রীরোগ ও বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ
পরিচালক, লিন নিসসা ফার্টিলিটি সেন্টার
আমি বাবা-মায়ের একাদশতম এবং সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। আমার বাবা আবদুর রশিদ চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ইয়াসিননগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবসা করতেন। ছিলেন একজন উদার মনের মানুষ, যার শখ ছিল মানুষকে আপ্যায়ন করা আর বিপদে পাশে দাঁড়ানো। বাবার কাছ থেকেই আমি মানবতাবোধ শিখেছি। তিনি বলতেন, স্বাস্থ্যসেবা শুধু ব্যবসা নয়, এটা আল্লাহর বান্দাদের সেবা করার সুযোগ। প্রতিটি রোগী আল্লাহর পাঠানো অতিথি, যার মাধ্যমে আমাদের পরীক্ষা হয়। সেই অতিথির যত্ন নিতে হবে আন্তরিকভাবে। কর্মচারীদের প্রতিও তাঁর ছিল অসম্ভব ভালোবাসা। কখনো একা খাননি। সবসময় কর্মচারীদের সঙ্গে একই টেবিলে, একই খাবারে বসতেন। গৃহকর্মী-কেয়ারটেকারদের সম্মান করতেন, সালাম দিতেন। বাবার এই সহজ, কোমল আচরণ আজও আমার কর্মজীবনের পথ দেখায়। আমি চেষ্টা করি কর্মীদের বন্ধু হয়ে থাকতে। বাবা আমাকে বলতেন, ‘কখনো অহংকার করো না। অহংকার মানুষকে শেষ করে দেয়।’ বাবার সেই শিক্ষা আমি আজও ধারণ করি।
ডা. রেশমা শারমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে। পরবর্তীতে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি এফসিপিএস এবং যুক্তরাজ্য থেকে এমআরসিওজির মতো একটি মর্যাদাপূর্ণ ডিগ্রি অর্জন করেন। এসএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৬তম এবং চট্টগ্রাম বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে ৮ম স্থান অর্জন করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে অধ্যয়ন করেন। তিনি ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিতে জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি উন্নত ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
‘বাবা, ফার্স্ট হইতে হবে কিন্তু’
ড. ইয়াসীর মুহাম্মদ তাসিফ খান
বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার, যুক্তরাষ্ট্র। ইউএস এয়ার ফোর্স আর্লি ক্যারিয়ার এওয়ার্ড ২০২৪, গুগল রিসার্চ স্কলার ২০২৩
আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ে বাসায় ফিরেছি। খুশির খবরটা বাবা-মাকে বললাম। উনারাও খুশি। তবে রাতে বাবা হেসে বললেন, ‘বাবা, ফার্স্ট হইতে হবে কিন্তু।’
শুধু কথাটা নয়, যেন ওটা আমার ভেতরে গেঁথে গেল। স্কুল, কলেজে আর ফার্স্ট হতে পারিনি। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং স্নতকে সেটা করতে পেরেছিলাম। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট ডালাস থেকে সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে স্নাতক শেষ করি। সার্টিফিকেটের চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন আমার গ্রেডশিট দেখে। সেটাও তিনি ফ্রেম করে রেখেছিলেন।
আমার বাবা, অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফয়েজ আহমদ খান। একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক, মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক। জন্ম চট্টগ্রামের দোহাজারী গ্রামে। কৃষিপ্রধান পরিবার থেকে উঠে এসে পড়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক)। দাদা মিছির খান বলেছিলেন, ‘মানুষের সেবার জন্য ডাক্তারি করবা।’ সেই কথাই জীবনের ব্রত করে নিয়েছিলেন তিনি। ক্যারিয়ারের শেষদিকে চমেক ও ইউএসটিসি-তে কমিউনিটি মেডিসিনের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। সরকারি দায়িত্ব ও শিক্ষকতা, উভয় জায়গায় পেয়েছেন মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
আমরা তিন ভাই। একজন ডাক্তার, দুইজন ইঞ্জিনিয়ার। পড়াশোনা আর পরিশ্রমের শিক্ষা পেয়েছি বাবার কাছ থেকেই। অসম্ভব পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। সিভিল সার্জন হয়েও বাসার রাজমিস্ত্রিদের সাথে কাজ করতেন। এলাকার মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। কাজের প্রতি এই শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা আর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত এখনো আমার জন্য অনুপ্রেরণা। পিএইচডি কিংবা গবেষণায় ফার্স্ট হওয়া যায় না। তবে কঠোর পরিশ্রম করে মানুষের জন্য কাজ করে যেতে হয়। সেটাই বাবার কাছ থেকে শেখা। এখন সেই শিক্ষাই আমার ছেলে এবং ছাত্রদের দিয়ে যেতে চাই।
ড. ইয়াসীর মুহাম্মদ তাসিফ খান বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। গবেষণা করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওয়্যারেবল, ইমপ্লান্টেবল ও ইনজেস্টিবল ইলেকট্রনিক্স নিয়ে গবেষণার জন্য ড. তাসিফ খান ২০২৫ সালে ইউএস এয়ার ফোর্স আর্লি ক্যারিয়ার এওয়ার্ড, ২০২৪ সালে প্যাকার্ড ফেলোশিপ এবং ২০২৩ সালে গুগল রিসার্চ স্কলার এওয়ার্ডে ভূষিত হন।
‘সবার ভালো চাইতে হবে’
ড. আদনান মান্নান
অধ্যাপক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমি যখন নিজের সাফল্যের দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই এক নিবেদিতপ্রাণ মানুষের অবয়ব। তিনি আমার বাবা, ডা. এম এ মান্নান। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সরল গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটা নিজের জীবনকে শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।
অত্যন্ত প্রতিকূলতার ভেতর বড় হয়ে অনেক কষ্টে পড়াশোনা করেছেন। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অনেকটা পথ হেঁটে স্কুলে যেতেন। তারপর চট্টগ্রাম কলেজ হয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শুরুর দিকের ব্যাচে। খুব অল্প বয়সেই বাবা-মা হারান। তবুও স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। নিজের প্রচেষ্টায় হয়ে ওঠেন দেশের অন্যতম মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন লন্ডন থেকে। ইউরোপের নানা দেশে ফেলোশিপের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার।
বাবার কাছে জীবনে টাকা-পয়সা নয়, মানুষের জন্য কিছু করতে পারা ছিল বড় বিষয়। প্রতি মাসে নিজের উপার্জনের একটা বড় অংশ অপারেশনের খরচ, হাসপাতালে ভর্তি কিংবা বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দিতেন। আমরা কখনো জানতাম না। পরে সেই মানুষগুলো এসে বাবাকে খুঁজে নিয়ে ধন্যবাদ জানাতেন।
বাবা চেয়েছিলেন আমরা যেন সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করি। কখনো টেম্পোতে, কখনো রিকশায়, আবার কখনো হেঁটে স্কুলে পাঠাতেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবনে বড় হওয়া মানে সবাইকে শ্রদ্ধা করা শেখা। সেই শিক্ষাই আমাদের রক্তে মিশে গেছে।
বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। এখনও তিনি প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে বই পড়েন। আর সবসময় বলতেন, ‘মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।’ আমার বোন যখন সংসারের চাপ সামলে চাকরি ছাড়তে চাইছিল, বাবা তাকে মানা করেন।
আমার জীবনের প্রথম উপার্জনের টাকা দিয়েছিলাম মাকে আর নানুকে- বাবার উপদেশেই। কারণ, বাবা বলতেন, ‘মায়ের তুলনা এই পৃথিবীতে কিছুই হতে পারে না।’ মা-হারা শৈশবের বাবার কাছে আমার নানুই ছিলেন সেই জায়গায়।
আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেই পথের প্রতিটি ধাপে আছেন আমার বাবা। আমার সুপারহিরো, আমার আশ্রয়, আমার বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
ড. আদনান মান্নান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক। জীবপ্রযুক্তি গবেষণায় দেশে শীর্ষ তরুণ গবেষকদের একজন। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেছেন পিএইচডি, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ হাল থেকে করেন মাস্টার্স। কর্মজীবনে অর্জন করেছেন অস্ট্রেলিয়ান পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এওয়ার্ড, বাংলাদেশ সোসাইটি অফ মাইক্রোবায়োলজি থেকে ‘ইয়াং ইমার্জিং সায়েন্টিস্ট ২০২২, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় ‘চ্যাম্পিয়ন অফ থ্রি মিনিট থিসিস’। গবেষক হিসেবে ফেলোশিপ পেয়ে কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি এবং ওরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটি তে।
পূর্বকোণ/এএইচ