চট্টগ্রাম রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫

সর্বশেষ:

শহরতলীর ‘দুঃখ’ গণপরিবহন
ফাইল ছবি

শহরতলীর ‘দুঃখ’ গণপরিবহন

মিজানুর রহমান

১৫ জুন, ২০২৫ | ১০:৫৯ পূর্বাহ্ণ

ফতেয়াবাদের ওমর শরীফ কাজ করেন নিউ মার্কেট এলাকার একটি দোকানে। সকালে ৩ নম্বর বাসে বাড়ি থেকে নিউ মার্কেট আসেন। রাতে একইভাবে বাড়ি ফিরেন। মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের এই পথ যাতায়াতে তার ব্যয় হয় তিন ঘণ্টার বেশি। তবুও জীবিকার টানে প্রতিদিন আসতে হয় কর্মস্থলে। ফতেয়াবাদের পর নাজিরহাট এলাকা। এখানকার মোহাম্মদ আলমগীর কাজ করেন নগরের দুই নম্বর গেটে। যাতায়াতের ভোগান্তি কমাতে শহরেই বাসা নিয়ে থাকছেন তিনি। আলমগীরের ভাষ্য- ‘প্রতিদিন এতো এতো ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে বাসে এসে তো অফিস করা সম্ভব না। কী আর করব বলেন?’

 

শহরতলী থেকে শহরে যাতায়াতের মাধ্যম নিয়ে ওমর বা আলমগীরের মতো ত্যক্ত-বিরক্ত মানুষের সংখ্যা কম নয়। কারণ শহর লাগোয়া হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, বোয়ালখালী, পটিয়া, দোহাজারী, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই থেকে প্রতিদিন অন্তত ১ লাখ মানুষ জীবিকার টানে শহরে আসেন। আবার ফিরে যান।

 

যাত্রীরা কেন ত্যক্ত-বিরক্ত?

শহরতলী থেকে সড়ক পথেই সবচেয়ে বেশি মানুষ শহরে যাতায়াত করেন। তাই এই পথে তাদের যাত্রার চিত্র দেখতে আমরা যাই; হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ এলাকায়। শুধু আমরা নই-শহরে যেতে সকাল থেকেই এখানে জড়ো হন কর্মজীবীরা। একটি বাসের অপেক্ষায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে ছিলেন সবাই।

 

সকাল ৯টার দিকে লক্কড় মার্কা একটি বাস আসতেই হুড়োহুড়ি ঠেলাঠেলি আর হইচই। ভিড় ঠেলে ৩ নম্বর রুটের ওই বাসে কোনোরকম ওঠার সুযোগ মিলে। তবে কিছুদূর এগোতেই হোঁচট খাওয়ার মতো থেমে যায় বাসটি। জানালার কাচগুলো ভাঙা। এর ফাঁক দিয়ে দেখা গেল হেলপার চৌধুরীহাট নেমে যাত্রী ডাকছেন। অথচ পুরো বাস তখন যাত্রীভর্তি। তিল ধারণের ঠাঁয়ও নেই।

 

জ্যৈষ্ঠ মাসের ভ্যাপসা গরমে যাত্রীরা কেউ ঘামছেন। কারও শরীর থেকে আসছে ঘামের দুর্গন্ধ। যাত্রী ওঠা-নামায় বাস যতবার থামছে, ততবার যাত্রীদের অনেকে একজন আরেকজনের ওপর গিয়ে পড়ছেন। এরমধ্যেই ভাড়া নিয়ে এক যাত্রীর সঙ্গে বাহাস শুরু করেন হেলপার। সেটি মিটতেই চালকের সঙ্গে বাস থামা নিয়ে বাহাসে জড়িয়ে পড়েন আরেক যাত্রী।

 

কচ্ছপ গতিতে চলা বাস অক্সিজেন মোড় পার হতেই যেন কিছুটা গতি পায়। হামজারবাগ পর্যন্ত চলে আরেক বাসের সঙ্গে ‘ওভারটেকিং’ প্রতিযোগিতা। এতে জিতে চালককে কিছুটা ফুরফুরা মনে হলো। মুরাদপুর যেতেই সিগারেট ধরালেন। তার ধোঁয়ায় মুহূর্তেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন পেছনের যাত্রীরা। কেউ মুখ চেপে ধরলেন, কেউ কেউ স্বাভাবিক। যেন এটাই নিয়ম!

 

ততক্ষণে সিট পাওয়া গেল। পাশের যাত্রী ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। গল্পের ছলে জানলাম- তিনি প্রতিদিনই এ পথে যাতায়াত করেন। ভ্রমণ অভিজ্ঞতা জানতে চাইলাম। উত্তর দিলেন মজা করেই। বললেন- ‘জাহান্নাম তো চোখে দেখা যায় না। গণপরিবহনে চড়বেন। ফিল পাবেন!’ ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে ১০টার ঘরে। বাস পৌঁছাল নিউ মার্কেটে। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

 

তাহলে সমাধান কী?

প্রতিদিন শহরে যাতায়াতকারী মানুষের ভোগান্তি কমাতে বিশেষজ্ঞরা গুরুত্ব দিলেন কলকাতা শহরের মতো রেল যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর। তারা জানালেন-চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, চট্টগ্রাম-দোহাজারী ও চট্টগ্রাম-মিরসরাই পর্যন্ত রেলপথ আছে। এসব রেলপথ ব্যবহার করে পর্যাপ্ত কমিউটার এবং লোকাল ট্রেন পরিচালনা করা গেলে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারবে।

 

চট্টগ্রাম শহরের চতুর্দিকে রেল নেটওয়ার্ক রয়েছে জানিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার পূর্বকোণকে জানান, এই নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে একসঙ্গে অনেক মানুষ পরিবহন করা সম্ভব। এতে শহরতলীর মানুষের যাত্রা নিরাপদ ও আনন্দদায়ক হবে। সড়কে মানুষের চাপ কমবে। শহরতলীর বাড়ি ছেড়ে শহরে বাসা নেওয়ার প্রবণতাও কমবে।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান-একটা সময় চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটে ৩ জোড়া কমিউটার ও ২ জোড়া লোকাল ট্রেন চলতো। তবে এখন চলছে মাত্র ১ জোড়া লোকাল ট্রেন। তাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে দুই জোড়া কমিউটার ও এক জোড়া লোকাল ট্রেন চলতো। এখন এই রুটে কোনো ট্রেন চলে না। চলছে না চট্টগ্রাম-পটিয়া রুটের এক জোড়া কমিউটার ট্রেন। সম্ভাবনা থাকলেও চট্টগ্রাম-মিরসরাই রুটে কোনো লোকাল ট্রেন চালানো হয়নি।

 

কেন সংকটে স্বল্প দূরত্বের ট্রেন?

রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন-লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ও কোচ স্বল্পতার কারণেই স্বল্প দূরত্বের ট্রেনগুলো নিয়মিত পরিচালনা করা যাচ্ছে না। গত দেড় দশকে রেলওয়ের উন্নয়নে সরকার এক লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করলেও এর পরিষেবা সক্ষমতা বাড়েনি। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হলেও ইঞ্জিন, কোচ ও জনবল সংকটের কারণে সেগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

রেলওয়ের তথ্যানুযায়ী-পূর্বাঞ্চলের অধীন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে লোকোমোটিভ রয়েছে ১১৯টি। এরমধ্যে গড়ে পাওয়া যায় ৮০টি। লোকোমোটিভের সংকট থাকায় লোকাল ট্রেনগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্বল্প দূরত্বের এসব ট্রেনের জন্য ৩১৩টি কোচ থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ডেমু ট্রেনগুলো বিকল হয়ে যাওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়েছে কমিউটার ট্রেন সেবাও। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো স্বল্প দূরত্বের ট্রেন পরিষেবায়।

 

রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, স্বল্প দূরত্বের ট্রেনের চেয়ে আন্তঃনগর ও মালবাহী ট্রেন চালানো বেশি লাভজনক। লোকোমোটিভ, কোচ সংকটের পাশাপাশি একে একে লোকাল ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে এটাও একটি কারণ। কারণ আপনি সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে চাইবেন- এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রেও রেলওয়েও তাই করছে।

 

উদ্যোগের অভাব দেখছেন বিশেষজ্ঞরা:

স্বল্প দূরত্বের ট্রেন বন্ধের পেছনে রেলওয়ের এসব যুক্তি মানতে নারাজ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার। রেল নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করা এই নগর পরিকল্পনাবিদ পূর্বকোণকে বলেন, এগুলো কারণ হতে পারে না। আপনার ইঞ্জিন বা কোচ না থাকলে আমদানি করেন। সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যেই এসব আনা যায়। সৎ এবং দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনা থাকলেই এটি করা সম্ভব।

 

রেলের কর্তারা যা বললেন-

সংকট কাটাতে লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ও কোচ কেনার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহা-ব্যবস্থাপক মো. সুবক্তগীন। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, আমরা লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ও কোচ কেনার উদ্যোগ নিয়েছি। পর্যাপ্ত লোকোমোটিভ ও কোচ পেলে বন্ধ লোকাল ট্রেনগুলোর পাশাপাশি যাত্রী চাহিদা অনুযায়ী নতুন ট্রেনও চালু করতে পারবো।

 

একই আশাবাদ ব্যক্ত করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, চলতি বছর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে নতুন ৫০টি কোচ আসার কথা রয়েছে। এর বাইরেও নতুন কোচ ও লোকোমোটিভ আনার প্রক্রিয়া চলছে। আশা করছি, বন্ধ লোকাল ট্রেন দ্রুত চালু করা সম্ভব হবে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট