চট্টগ্রাম সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

বৃদ্ধাশ্রমে দুই বাবার করুণ আর্তনাদ

জাহেদুল আলম

১৮ জুন, ২০২৩ | ১২:২৩ অপরাহ্ণ

‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্ল্যাটে যায়না দেখা এপার-ওপার, নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি। সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাদ সম্ভ্রম, আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম…..। জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী নচিকেতার এ হৃদয় নিংরানো গানের প্রায় প্রতিটি কলি রাউজান নোয়াপাড়া আমেনা বশর বয়স্ক পুনবার্সন কেন্দ্রে (বৃদ্ধাশ্রমে) ঠাঁই নেয়া ৭১ বছর বয়সী বোধিপ্রিয় বড়ুয়া এবং সমবয়সী এয়ার মোহাম্মদের জীবনের সাথে পুরোপুরি মিলে গেছে। বোধিপ্রিয় বড়ুয়া সারাজীবনের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করেছেন স্ত্রী, সন্তানদের ডিগ্রি অর্জন, তাদের মানুষ গড়ার পেছনে। সেই বোধিপ্রিয়ই বৃদ্ধ বয়সে হয়ে পড়লেন বড় একা।

 

সরেজমিনে পরিদর্শনে গেলে কথা হয় বোধিপ্রিয়’ বড়ুয়ার সাথে। তিনি বলেন ‘আমি গ্র্যাজুয়েট। যখন বিয়ে করি, স্ত্রী তখন মেট্রিক (এসএসসি) পাস ছাত্রী ছিল। বিয়ের পর তার (স্ত্রীর) পড়ালেখা চালিয়ে যাই। সে এলএলবি পাস করে এখন হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবি। দুই ছেলেকেও মাস্টার্স পাস করাই। একজন ব্যারিস্টার। আরেকজন চাটার্ট একাউন্ট্যান্ড। আমার এখন পড়ন্ত বয়স। বড় আইনজীবী হয়ে স্ত্রী এখন আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কোনদিন খোঁজও নেননি। সন্তানরা মায়ের সাথে ঢাকায় থাকে। তারা মায়ের কথার বাইরে যায় না। তাই আমি একা পড়ে গেছি।’  বোধিপ্রিয় বড়ুয়া আপসোস নিয়ে বলেন ‘সবকিছু থেকেও বৃদ্ধাশ্রমে এখন চা খুঁজে খাই। একা একা জীবন কাটছে এখন।’

 

নোয়াপাড়া আমেনা বশর বয়স্ক পুনবার্সন কেন্দ্রে বয়স্ক বাবাদের মধ্যে আরেকজন পটিয়া উপজেলার ভাটিয়াইন ১৪ নম্বর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বদি আলম তালুকদার বাড়ির বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী এয়ার মোহাম্মদ। স্ত্রী, তিন ছেলে, ২ মেয়ে থাকলেও স্ত্রী, সন্তাদের কাছে বোঝা হয়ে পড়া বাধ্য হয়েই এই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন।  তিনি বলেন ‘পটিয়ার নামকরা বাবুর্চি ছিলাম। সারাজীবনের অর্থ ব্যয় করে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছি। দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ৩ ছেলে নানা পেশায় জড়িত। এক মেয়ে বিবাহিত। আরেকজন অবিবাহিত। আমি অক্ষম হয়ে পড়ার পর থেকে স্ত্রী, সন্তানদের কাছে আমি বোঝা হয়ে গেছি। তারা আমার ভরণপোষণ করেনা। ওষুধ খরচ দেয় না। স্ত্রী, সন্তানরা আমাকে বলেছে ‘তোমার ব্যবস্থা তুমি করো।’ বাধ্য হয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চান্দগাঁও থানার এক পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে আমি নোয়াপাড়া আমেনা বশর বয়স্ক পুনবার্সন কেন্দ্রে (বৃদ্ধাশ্রম) মাথা গোজার ঠাঁই নিই। প্রায় দশমাস ধরে এখানে আছি। একবার ছোট ছেলে দেখতে আসলেও এতদিনে আর কেউ আমাকে দেখতে আসেনি। এমনকি গেল ঈদেও আমার কোন খোঁজ নেয়নি স্ত্রী, সন্তান কিংবা স্বজনরা। আমি নিজে ফোন করলেও রিসিভ করে না। আসার সময় পরিবারকে বলে এসেছি, এটাই আমার শেষ বের হওয়া। আর বাড়ি ফিরবো না। এখানে মরলে, এখানেই আমার জানাজা-দাফন দিতে বলেছি কেয়ারটেকার হারুনকে।’

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট