চট্টগ্রাম শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪

স্বপ্ন দেখাচ্ছে কাজু বাদাম

১২ এপ্রিল, ২০২২ | ১:৪৮ অপরাহ্ণ

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ও মিনারুল হক

বাজার সংকট ও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এক সময়ে কেটে ফেলা হয় কাজু বাদামের গাছ। এখন দেশ-বিদেশে চাহিদা বেড়েছে এ কৃষি পণ্যটির। আমদানি করেই মেটানো হয় দেশীয় চাহিদা। বেসরকারি উদ্যোগে প্রসেসিং কারখানা স্থাপন ও রপ্তানি প্রক্রিয়ার পর কাজু বাদামের কদর কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সরকারও কাজু বাদামের আবাদ বাড়াতে বড় প্রকল্প নেয়। এর ফলে পাহাড় অঞ্চলে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ‘কাজু বাদাম’।

কাজু বাদাম ও কফি চাষাবাদ বাড়াতে ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প নেয় সরকার। দেশের চার বিভাগের ৯ জেলায় এ প্রকল্প নেওয়া হয়। এরমধ্যে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটিতে কাজু বাদামের অমিত সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে কাজু বাদাম ও কফির উন্নত জাত উদ্ভাবন, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, জাত সংরক্ষণ-উন্নয়ন, চাষীদের প্রশিক্ষণ, চারা-কলম বিতরণ এবং কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পৃথক আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

কৃষি গবেষণা সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক শহীদুল ইসলাম জানান, গত বছরের জুন থেকে তিন পার্বত্য জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের আওতায় এক লাখ ৮০ হাজার কাজু বাদামের চারা বিতরণ করা হয়েছে। ৭ হাজার চাষীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ থেকে কয়েক বছরে দু’ হাজার টন কাজু বাদাম উৎপাদনের আশা করছেন প্রকল্প পরিচালক।

কাজু বাদামের ইতিহাস বলছে, ৩০-৩৫ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং উদ্যান উন্নয়ন বিভাগ (কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ) যৌথভাবে কাজু বাদামের চারা সরবরাহ করেছিল। ফলনও ভালো হয়েছিল। কিন্তু কাজু বাদাম বাজার ও প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা ছিল না। শুধু রাঙামাটিতে দেশীয় পদ্ধতিতে স্বল্প কিছু কাজু বাদাম প্রক্রিয়াজাত করা হতো। দাম না পাওয়া ও প্রক্রিয়াজাতের অভাবে অনেকেই কাজু বাদামের গাছ কেটে অন্য চাষ শুরু করেন।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানে ৯০-এর দশকে রোয়াংছড়ি, রুমা, থানছি এলাকার জুমিয়ারা কাজু বাদাম চাষ শুরু করেন। উৎপাদিত কাজুবাদামের ক্রেতা ছিল চট্টগ্রাম নগরীর খাতুনগঞ্জ ও স্থানীয় আড়তদাররা। গত কয়েক বছর আগেও মণ প্রতি ১২ শ টাকায় বেচাকেনা হতো। তার উপর ছিল দাদন-যন্ত্রণা। দাদনদারদের কাছে মণপ্রতি ৮ শ টাকা থেকে ৯ শ টাকায় বিক্রি করতে হতো। এখন চাহিদায় বাড়ায় মণপ্রতি ৩ হাজার ৫ শ থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত দাম পাচ্ছেন চাষীরা।

কৃষি বিভাগ বলছে, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে মূলত বান্দরবানে বেশি কাজুবাদামের ফলন হয়। এখন খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতেও আবাদের পরিমাণ বাড়ছে। পার্বত্য এলাকায় ২০১৮ সালে কাজু বাদামের ফলন হয়েছিল ৯৬২ টন। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৩২৩ টনে

প্রকল্পের সমন্বয়ক ড. আলতাফ হোসেন পূর্বকোণকে বলেন, কাজু বাদামের দাম না পাওয়ায় এক সময়ে চারা কেটে ফেলা হয়েছিল। এখন দেশে-বিদেশে চাহিদা বেড়েছে। নতুন করে চাষাবাদ হচ্ছে। তিনি বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে ৫ লাখ হেক্টর পতিত জমি রয়েছে। এরমধ্যে দুই লাখ হেক্টরে কাজু বাদামের চাষ করা গেলে ৮-৯ হাজার টন কাজু বাদামের আশা করছি আমরা। এরফলে দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্যজেলার মধ্যে ১৬ উপজেলায় গবেষণা কার্যক্রম চলছে। ২০টি স্থানে উপযোগিতা পরীক্ষা (সম্ভাব্যতা যাছাই) কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়াও খাগড়াছড়িতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হিমাগার, গুদাম স্থাপন, বান্দরবানে কার্যালয় ও রাঙামাটির রায়খালিতে কৃষি গবেষণাকেন্দ্রে বীজ উদ্ভাবন, সংরক্ষণসহ প্রকল্পের কাজ চলছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, দেশে প্রতি বছর মাত্র দুই হাজার টন কাজু বাদাম উৎপাদন হয়। দেশে ১০ লাখ হেক্টর কাজু বাদাম চাষের উপযোগী জমি রয়েছে। এসব জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হলে দেশে কাজু বাদামের উৎপাদন ১০ লাখ টনে দাঁড়াবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ২ লাখ হেক্টর জমিতে ১৫ কোটি গাছ রোপণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। চলতি মৌসুমে ৮০ হাজার মে. টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

বান্দরবানের রুমা উপজেলার কাজু বাদাম চাষী ক্য শৈনু মারমা ও উথোয়াই মং পূর্বকোণকে বলেন, ‘চাষীরা এখন মণপ্রতি প্রায় চার হাজার টাকা দাম পাচ্ছেন। আড়তদার ও প্রসেসিং কারখানার মালিকেরা প্রতিযোগিতামূলক দামে কাজুবাদাম কিনছেন। এতে লাভবান হচ্ছেন চাষীরা। ভালো দাম পাওয়ায় চাষাবাদে আগ্রহ বেড়েছে। হচ্ছে নতুন নতুন বাগান।’ তারা বলেন, এ খাতে চাষীদের প্রশিক্ষণ ও ব্যাংক ঋণ নিশ্চিত করা হলে চাষীরা আরও উপকৃত হবে।

বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, জেলার ১৮৩৭ হেক্টর জমিতে কাজু বাদাম চাষ হচ্ছে। উৎপাদন হচ্ছে এক হাজার ৩২৩ মে. টন। ইতিমধ্যে কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগ থেকে ৭৪ হাজার কাজুবাদাম চারা বিতরণ করা হয়েছে। চাষ সম্প্রসারণে সরকারের একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নের এখাতে বড় সাফল্য আসছে। প্রতি হেক্টরে দেড় থেকে দুই মে. টন বাদামের ফলন হয়।

প্রসেসিং কারখানা: কৃষি সম্প্রসারণ ও গবেষণা অধিদপ্তর জানায়, দেশের ১৪টি প্রসেসিং কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে পতেঙ্গা একটি, কর্ণফুলীতে দুটি ও বান্দরবানে একটি প্রসেসিং কারখানা রয়েছে।
২০১৬ সালে দেশে প্রথম কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতের কারখানা শুরু করেন উদ্যোক্তা শাকিল আহমদ। তার দেখাদেখি আরও কয়েকটি প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে ওঠে। এর ফলে দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনাও দেখাচ্ছে। এছাড়াও ২০১৮ সালে কর্ণফুলী উপজেলায় টু এইচ ফ্রুট ইন্ডাস্ট্রি নামে কাজুবাদামের কারখানা গড়ে তুলেন দু’জন উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তারা বলেন, দেশে দ্রুত চাহিদা বাড়ছে। আবার রপ্তানির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। স্থানীয়ভাবে বাজারজাতের পাশাপাশি কয়েকজন উদ্যোক্তা রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছেন।

২০১৯ সালে বান্দরবানের বালাঘাটায় কয়েকজন তরুণ উদ্যোক্তা ছোট পরিসরে কাজুবাদাম প্রসেসিং কারখানা স্থাপন করে। ৪-৫ মাস আগে কাঁচামাল সংকটে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকার পরও নানা সংকটে এগোতে পারেনি। তবে সরকারে উদ্যোগের ফলে কাজু বাদামে অর্থনীতির নতুন দুয়ার উন্মোচনের সম্ভাবনা দেখছেন পার্বত্যবাসীরা।

বান্দরবান বালাঘাটার কৃষাণ ঘর এগ্রো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিকুল ইসলাম জানান, ‘রপ্তানিযোগ্য পণ্য হওয়ায় দেশে কাজু বাদাম চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ খাতটি স¤প্রসারণে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি হয়ে যাওয়ায় দেশীয় কারখানাগুলো মার খাচ্ছে। অপরদিকে বেশি দামে বিদেশ থেকে কাজু আমদানি করতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে কাজু বাদাম তৃতীয় অর্থকরী ফসল। এর বীজ থেকে পাওয়া বাদাম সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও মূল্যবান। বাদামের উপরের অংশের ফল থেকে জুস, ভিনিগার এবং এলকোহল তৈরি করা যায়। তাছাড়াও বাদামের খোলসে তৈলশিল্প কাজে ব্যবহৃত মূল্যবান দ্রব্য।

 

পূর্বকোণ/এস

শেয়ার করুন