চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

চিকিৎসা বিজ্ঞানের বারোটা ফার্মেসিওয়ালাও চিকিৎসক!

মাসুম খান

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৪১ পূর্বাহ্ণ

গত বছরের বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ার শিমুল মেডিকো নামের ফার্মেসিতে সমীর দাশ (৩৬) নামে এক পত্রিকা হকারের অস্ত্রোপচারের ৪ দিন পর মারা যান তিনি। সমীরের পরিবারের অভিযোগ ওই অস্ত্রোপচারের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
পরিবারের অভিযোগ, উপজেলার একটি ওষুধের দোকানে গত বছরের ৩ এপ্রিল সমীরের কোমরের মেরুদ-ে অস্ত্রোপচার করেন এমকে ধর নামের এক ‘চিকিৎসক’। এরপর সমীরের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে নগরীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ এপ্রিল মারা যান তিনি।
তবে এখন প্রশ্ন ? ফার্মেসিতে কি অস্ত্রপাচার ও যিনি অস্ত্রপাচার করেছেন তিনি কি কোন ডিগ্রিধারী ডাক্তার নাকি ফার্মেসিতে বসে কয়েকটি ওষুধের নাম জানার ফলে ডাক্তার সেজে বসে আছেন। হয়তো পাঠকরা বলবেন এমন চিত্র দেশজুড়ে।
ফার্মেসি কারা পরিচালনা করবেন : সূত্রমতে দেশে কয়েক লাখ ফার্মেসির বিপরীতে ফার্মাসিস্টের সংখ্যা মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার। এর মধ্যে ‘এ’ এবং ‘বি’ গ্রেডের ফার্মাসিস্ট আছেন মাত্র ১৪ থেকে ১৫ হাজার। এ গ্রেডের ফার্মাসিস্টরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি ফার্ম বা এম ফার্ম ডিগ্রিধারী। তারা ওষুধ বিক্রির জন্য ফার্মেসিতে কাজ করেন না। তারা মূলত ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। বি গ্রেডের ফার্মাসিস্টরা বিভিন্ন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ইন্সটিটিউট বা কলেজের অধীনে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী। তারাও ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রি করেন না। তারা সরকারি রেজিস্ট্রার্ড হাসপাতাল, ক্লিনিক বা কর্পোরেট অফিসে সহকারী ফার্মাসিস্ট হিসেবেই কাজ করতে বেশি পছন্দ করেন। আর সি গ্রেডের ফার্মাসিস্টরা মাধ্যমিক (এসএসসি) অথবা উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর যোগ্যতাসম্পন্ন, যারা বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের অধীনে ফার্মেসি রেজিস্ট্রেশন কোর্স সম্পন্ন করেছেন। এদের সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৫ হাজার। দুঃখজনক হচ্ছে, প্রতিবছর প্রায় ৪ হাজার সি গ্রেডের ফার্মাসিস্ট বের হন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে চলে যান। ফার্মেসিগুলোতে ডিপ্লোমাধারী ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করা জরুরি। ফলে যার তার কাছে যে কোন ধরনের ওষুধ বিক্রির প্রবণতা বন্ধ হবে। পাশের দেশ ভারতে ইতোমধ্যেই প্রত্যেক ফার্মেসিতে একজন করে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী ফার্মাসিস্ট নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ফার্মেসির চিকিৎসায় কারা ভরসা রাখে : গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ও শহরের নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষজন ফার্মেসির চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চান। কারণ হিসাবে দেখা যায়, গ্রামগুলোতে সরকারি হাসপাতাল থাকলেও সরকারি বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা নিয়মিত চেম্বার করেন না। অধিকাংশ সরকারি ডাক্তাররা গ্রামের হাসপাতালে পোস্টিং হলেও সেখানে একদিনের জন্যও যান না তার সংখ্যাও কম নয়। তার বদলে তারা বেসরকারি চেম্বার করতে বেশি পছন্দ করেন। কারণ হিসাবে বলা যায়, বেসরকারি চেম্বারে তাদের আয়ের মাত্র বেড়ে যায়। অন্যদিকে শহরের অলি-গলিতে বাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে অসংখ্য ফার্মেসি। যার ফলে নিম্মবিত্ত ও মধ্য আয়ের মানুষগুলো ফার্মেসির চিকিৎসাতে ভরসা বা সন্তুষ্ট থাকতে চান। কারণ হিসাবে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে একজন রোগী যখন তার রোগ সারাতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হন তখন দেখা যায়, ডাক্তার ওষুধের বদলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন অনেক বেশি। অনেক সময় দেখা যায় ডাক্তারের দেয়া পরীক্ষাগুলো করানোর সামর্থ থাকে না রোগীদের। যার ফলে অনেক রোগী ডাক্তারের দেয়া পরীক্ষাগুলো বাদ দিয়ে ফার্মেসিতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে ওষুধ কিনে তার রোগ সারাতে পছন্দ করেন। তবে অভিযোগ রয়েছে রোগীকে দেয়া পরীক্ষার উপর একটা অংশের কমিশন পান ডাক্তাররা।
ফার্মেসিতে কোন কোন রোগের চিকিৎসা দেয়া হয় : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ প্রয়োজনে ওষুধ কিনে ফার্মেসি থেকে কখনও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে, কখনও ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই। আর এসব ফার্মেসি থেকেও অনায়াসে যে কোন ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে ক্রেতার কাছে, অনেক জটিল রোগের ওষুধও এরা বিক্রি করে কোন ধরনের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই। দেশের অধিকাংশ ফার্মেসিতে সকল রোগের ওষুধ বিক্রি করেন অবৈধ ও ভুয়া ফার্মাসিস্টরা।

স্পর্শকাতর, ঝুঁকিপূর্ণ নানা ওষুধ তারা বিনা ব্যবস্থাপত্রে তুলে দেন গণমানুষের হাতে। অনেক ওষুধেরই যে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে, সে বিষয়েও অনেক ওষুধ বিক্রেতার জ্ঞান নেই। নিম্নমানের, এমনকি ভেজাল ওষুধ গছিয়ে দিতেও তাদের বাধে না। ফলে রোগমুক্তির বদলে অনেক ক্ষেত্রেই জটিলতা বাড়ছে। ভেজাল ওষুধে, অপচিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা তো ঘটেছে বহুবার। (যা ১৯৮২ সালের ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের বিরোধী)। বাংলাদেশ সরকারের ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ অনুসারে প্রত্যেক ফার্মেসিতে একজন করে গভ. রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট থাকার নিয়ম রয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে এই আইনের বাস্তবায়ন নেই।
রোগীর শরীরে ওষুধ প্রয়োগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সতর্কতা : চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, রোগীকে একই সময়ে একটির বেশি ব্যাথা নাশক ওষুধ (ঘঝঅওউ) দিতে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ তা করলে কিডনি, পাকস্থলী এবং হৃদযন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে ! এমন কি সেটা রোগীর মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
ফার্মেসির ভূয়া ডাক্তারদের চিকিৎসায় মৃত্যুঝুঁকি কতটুকু : বিএএমএমইউর নিউরোলজী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ইলিয়াস দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, যে কোন ভেজাল ও নিম্নমান এবং ভুলভাবে ওষুধ গ্রহণ করাই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মান ঠিক না থাকলে গ্রহণকারীর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারকারীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি তাদের কেউ কেউ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পারেন।
করণীয় কি কি :
কঠোর আইন : বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে না ওঠার কারণে ফার্মেসি ভিত্তিক ভয়ঙ্কর ডাক্তারির প্রবণতা বন্ধ হওয়া দূরের কথা, সবাই যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দেশে ৮৭ শতাংশ ওষুধ বিনা ব্যবস্থাপত্রে বিক্রি হচ্ছে এবং ৬৪ শতাংশ বিক্রেতা উপসর্গ শুনে নিজেরাই ‘ডাক্তারি’ করছে। দেশে অনুমতিপ্রাপ্ত ফার্মেসির তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ওষুধ বিক্রির প্রতিষ্ঠান থাকলেও এর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলে না। বছরে হাতেগোনা কয়েকদিন অভিযান চালিয়ে দায়িত্ব পালন করেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযানে অনেক সময় ভুয়া ডাক্তার গ্রেপ্তার হলেও কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে পুনরায় পূর্বের পেশায় ফিরে যায় রাজার হালতে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অনিয়ম বন্ধে আইন হতে হবে অনেক বেশি কঠোর। এমন আইন তৈরি করতে হবে একবার গ্রেপ্তার হলে যাতে জামিন নিয়ে আর বেরুতে না পারে। তাহলে কিছুটা হলেও সম্ভব বন্ধ হবে এসব ভুয়া ডাক্তারদের ডাক্তারি।
জনসচেনতনতা বৃদ্ধি : রোগীর উচিত এমবিবিএস ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের আর ফার্মেসিওয়ালার কথায় ভালো-মন্দ যাচাই করা। ওষুধ কেনার সময় সতর্ক হতে এবং মানবহির্ভূত ওষুধ এড়িয়ে চলতে আমাদের। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ভুয়া ডাক্তার আর নকল ওষুধের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা চালানো। ভুয়া ডাক্তারদের চিহ্নিত করে তাদের তালিকা ব্যাপক হারে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্ততরের বক্তব্য : এসব প্রসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক হোসাইন মোহাম্মদ ইমরান বলেন, ‘ফার্মেসি দোকানগুলো শুধুমাত্র চিকিৎসকের দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ প্রদান বা বিক্রি করবেন। সর্বোচ্চ তারা রোগীকে ওষুধ সম্পর্কে বুঝিয়ে দিবেন। এর বাইরে কোনভাবেই তারা নিজে নিজে চিকিৎসা করে কিংবা প্রেসক্রিপশন লিখতে পারবে না। ইতোমধ্যে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন অনেকজনের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। একই সাথে নিয়মিতই প্রতিটি ফার্মেসি বা ওষুধ দোকানে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর তাদের অভিযান অব্যহত রেখেছেন।’
তবে যারা ফার্মেসি দোকানে চিকিৎসার জন্য ছুটে যায়, তাদেরও এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার উচিত। কেননা মানুষ ভাবে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে প্রচুর অর্থ ও শ্রম ব্যয় করতে হয়। আমি মনে করি এটাও একটা ভুল ধারণা। বর্তমানে প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে চিকিৎসকরা থাকেন, সেখান থেকেও মানুষ সেবা নিতে পারেন। তাহলে ফার্মেসি দোকানগুলোতে এমন চিকিৎসা কমে আসবে। একই সাথে আমাদেরও সচেতন বাড়াতে হবে বলে অভিমত এই কর্মকর্তার।
সিভিল সার্জনের বক্তব্য : চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি এ প্রসঙ্গে পূর্বকোণকে বলেন, সরকার প্রতিটি জেলা-উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু আমারা সেখান থেকে চিকিৎসা নিতে চাই না। কিছু হলেই আমরা ফার্মেসি দোকানে গিয়ে নিজে নিজে কিংবা ফার্মেসির দোকানদারের পরামর্শে ওষুধ নিয়ে ব্যবহার শুরু করে দেই। কিন্তু এটা বুঝি না, এমন ওষুধ ব্যবহার আমাদের উচিত নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ইউনিয়ন পর্যায়ের ডাক্তারের কাছে যাই না। আবার তিনি রাতে যে চেম্বারে বসেন, সেই চেম্বারেই এসে আমরা ভিড় করি। তাহলে পার্থক্য আর কোথায় থাকলো। আর ফার্মেসি দোকানদারদেরও ভাবা উচিত, এমন চিন্তা চেতনা থেকে ফিরে আসার। একটু অর্থের লোভে অন্যের ক্ষতি করা ঠিক নয়।
তাছাড়া যারা ফার্মেসি দোকানে বসে নিজেদের ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিয়ে মানুষকে ঠকাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে সবসময় সিভিল সার্জন ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন বলে জানান তিনি।

লেখক * নিজস্ব প্রতিবেদক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট