চলতি বছরেই বড় হয়েছে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট ব্রিকস। বর্তমানে জোটটির পূর্ণ সদস্য সংখ্যা ১০। মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব যুক্ত হওয়ার পর পাঁচটি সদস্য দেশ থেকে সম্প্রসারিত হয়ে ১০টিতে পরিণত হয়েছে। নতুন যুক্ত হওয়া এই পাঁচ দেশ আঞ্চলিক জোটটিকে আরও বেশি বহুমাত্রিক ও বৈশ্বিক করেছে। এছাড়া সম্প্রতি আরও ১৩টি দেশ ব্রিকসের অংশীদার হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়েছে।
ব্রিকস কী : ব্রিকস মূলত ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীন নিয়ে ২০০৯ সালে উদীয়মান অর্থনীতির জন্য একটি সহযোগিতা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গঠিত হয়। পরে ২০১০ সালে এতে দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দেয়। পরে আরও পাঁচ দেশ ব্রিকসে যোগ দেয়। উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের ধনী দেশগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে, বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একত্রিত করার জন্য এই অর্থনৈতিক জোট গঠিত হয়। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির একটি জোট হিসেবে আবিভর্‚ত হওয়ার মাধ্যমে ব্রিকস এখন জি-৭ এর বিকল্প একটি শক্তিকেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে পারে। জনসংখ্যার দিক থেকে এই সম্প্রসারিত জোট বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৬ শতাংশকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা জি-৭ এর মাত্র ৮ দশমিক ৮ শতাংশের তুলনায় অনেক বৃহৎ। এই স¤প্রসারণ বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং বাণিজ্যে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।
ব্রিকসের নতুন ৫ সদস্য : চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি ব্রিকসের সদস্য বাড়ানোর ঘোষণা দেন দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী নালেদি পান্দর। ২০২৩ সালের আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলনে সৌদি আরব, ইরান, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইথিওপিয়া ও আর্জেন্টিনাকে জোটের পূর্ণ সদস্য হতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটি দেশ নতুন করে যোগ দেয় আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে।
ব্রিকসের নতুন ১৩ অংশীদার : চলতি বছর ব্রিকসের অংশীদার হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়েছে আরও ১৩টি দেশ। এগুলো হলো- মালয়েশিয়া, আলজেরিয়া, বেলারুশ, বলিভিয়া, কিউবা, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান, নাইজেরিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, উগান্ডা, উজবেকিস্তান এবং ভিয়েতনাম। তবে তারা এখনও পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা পায়নি।
ব্রিকসে সবচেয়ে লাভবান কোন দেশ : সম্ভবত ভারত পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন পাওয়ার পরও ব্রিকস সদস্য হিসেবে জোটটির বিবর্তন এবং সম্প্রসারণের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীদের অন্যতম। এমনটাই জানিয়েছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টার’স সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান।
কুগেলম্যানের মতে, ভারত সম্ভবত সবচেয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন পাওয়ার পরও ব্রিকস সদস্য হিসেবে জোটটির বিবর্তন এবং সম্প্রসারণের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীদের একজন। বেশিরভাগ নতুন ব্রিকস সদস্যের সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মিশর মধ্যপ্রাচ্যে একটি ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও নিরাপত্তা অংশীদার। সংযুক্ত আরব আমিরাত সামগ্রিকভাবে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ইথিওপিয়ার সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক আফ্রিকার অন্য দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও গভীরতম। এছাড়া ব্রিকসের মূল সদস্যরা ভারতকেও গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা প্রদান করে যাচ্ছে।
পশ্চিমাদের বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ রাশিয়ার প্রতি ক্রমাগত অঙ্গীকারের ইঙ্গিত দিতে ব্রিকসকে সুবিধা দিতে পারে দিল্লি এবং ব্রিকসের মূল সদস্য চীনের সঙ্গে এক জোটে থাকাও দিল্লিকে বেইজিংয়ের সঙ্গে উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, চলতি বছরের সম্মেলনের প্রক্কালে ভারত চীনের সঙ্গে একটি সীমান্ত টহল চুক্তি করে ফেলতে সমর্থ হয়। এই ঘোষণা সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রয়োজনীয় ক‚টনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থান এনে দিয়েছে। ব্রিকস ভারতকে তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের মূল পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম করে। যার মাধ্যমে ভারত কারও সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রতা না করে ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের বিস্তৃত বৈচিত্র্যময় সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।
পশ্চিমের অভ্যন্তরে ও বাইরে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উভয়ক্ষেত্রেই দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব রয়েছে। সেই অর্থে ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী ব্রিকসে ভারতের উপস্থিতি ও এর সদস্যদের সাথে সম্পর্ক একটি পুনরুজ্জীবিত ইন্দো-প্যাসিফিক কোয়াডে অংশগ্রহণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির সাথে এর দৃঢ় সম্পর্কের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে। ব্রিকস পশ্চিমাবিরোধী জোট নয়। ইরান বাদে সব নতুন সদস্যেরই পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া আগামীতে যে কয়েকটি দেশের ব্রিকসের সদস্য হওয়ার কথা রয়েছে তারাও পশ্চিমাবিরোধী বলয় তৈরি করে না। তার মধ্যে একটি ন্যাটো সদস্য তুরস্ক, আর অন্যটি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অংশীদার ভিয়েতনাম। এমনকি যদি ব্রিকস আরও পশ্চিমাবিরোধী সদস্যকে তাদের জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে তাহলে সম্ভবত পশ্চিমাদের জন্য প্রকৃত হুমকি হতে পারে এমন উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করবে।
সাম্প্রতিক শীর্ষ সম্মেলনের পরে জারি করা যৌথ বিবৃতিতে একটি আন্তর্জাতিক অর্থপ্রদান ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা চিহ্নিত করা হয়েছে যা মার্কিন ডলারের মোকাবেলা করবে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়াতে পারবে। কিন্তু মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমাতে ব্রিকস প্রকল্পগুলো সম্ভবত কার্যকর নয়, কারণ অনেক সদস্য রাষ্ট্রের অর্থনীতি এটি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার সামর্থ্য রাখে না। অন্যদিকে, ব্রিকসে সম্প্রসারিত সদস্যপদ নিয়ে সংহতি এবং ঐকমত্য অর্জন করা আরও কঠিন হবে। ভারত হয়তো বেশিরভাগ ব্রিকস সদস্যের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে পারে, কিন্তু অনেক নতুন সদস্যের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নেই।
পূর্বকোণ/ইব