[ ইয়াহিয়া সিনওয়ারের জন্ম ১৯৬২ সালে। মৃত্যু ১৬ অক্টোবর, ২০২৪। খান ইউনিসে জন্মগ্রহণ করলেও গাজার শরণার্থী শিবিরে বড় হন তিনি। ১৯৮৮ সালে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ ২৩ বছর ইসরাইলের কারাভোগ করেন। কারাগারে থাকাকালেই হিব্রু ভাষা শিখেন এবং কিছু অনুবাদকর্ম করেন। ২০১১ সালে বন্দীবিনিময় চুক্তিতে ইয়াহিয়া কারামুক্ত হন এবং ২০১৭ সালে স্বাধীন ফিলিস্তিন আন্দোলনের হামাস দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একাধারে লেখক, গবেষক ও যোদ্ধা ছিলেন। অনেকটা কবি নজরুলের মতো ‘মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’। তিনি ২টি গবেষণা গ্রন্থ, ১টি আখ্যান ও ১টি উপন্যাস রচনা করেন।
মাতৃভূমির মুক্তির জন্য ইয়াহিয়া সিনওয়ার জীবন উৎসর্গ করেন। ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনীর গোলার আঘাতে এই মহান নেতা মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কিছুপূর্বে তিনি এই শেষ ইচ্ছাটি লিপিবদ্ধ করেন। দৈনিক পূর্বকোণ সম্পাদকের অনুরোধে পাঠকের জন্য কবিতার মতো নিচের এই গদ্যের ভাবানুবাদ করেছেন ডা. মো. সাজেদুল হাসান ]
আমি ইয়াহিয়া নিজ দেশে জন্ম নেয়া এক রিফিউজি, যুদ্ধকে পরিণত করা এক স্বপ্ন
এই শব্দগুলি যখন আমি লিখছি তখন খান ইউনিসের গলিতে বেড়ে ওঠা এক শিশুর ছেলেবেলা, রক্তঝরা দিন আর কারাগারের কথা মনে পড়ে।
আমি জন্মেছিলাম এইখানে এক ক্যাম্পের ভিতর
যখন প্যালেস্টাইন ছিল ভুলে যাওয়া
কোনো দেশের নাম, মুছে ফেলা মানচিত্র।
সেখানে জীবন ছিল যেন জ¦লন্ত উনুনের ছাই আর
ততদিনে জেনে গেছি জীবন শুধু এক অভিশপ্ত কারাগার।
বেঁচে থাকা এখানে সাধারণ কিছু নয়
নিয়তি বলে দেয় স্বাধীনতা বহুদূর।
তবুও যে শিশু জন্ম নেয় শত্রুর দিকে ছোড়া তার প্রথম ঢিলটির লক্ষ যেন হয় রিফিউজির বেদনায় নির্লিপ্ত পৃথিবী।
গাজার রাস্তায় আমি শিখেছি মানুষের জীবন শুধু বয়সে বেড়ে ওঠা নয়, মাতৃভূমির প্রতি ঋণের প্রতিদান।
আমার জীবন আজ তাই যুদ্ধ, হৃদয় মোচড়ানো বেদনা আর কারাগার
আমি তবু আশাবাদী হই।
যৌবনে আমার সাজা হয়েছিল আজীবন কারাবাস।
আমি তো ভীত হইনি, ভয় কাকে বলে আমার জানা ছিল না।
কারাগারের প্রতিটি দেয়ালে কল্পনায় এঁকেছি খোলা জানালা, তার ফাঁক গলে সুদূর দিগন্ত রেখা, গারদের শিকগুলো আলোর মিছিল।
এইভাবে কেটে গেছে জীবনের চব্বিশ বছর
আমি জানি অপেক্ষা আর ধৈর্য মামুলি ধর্ম নয়
বরং শাণিত অস্ত্র যেন সমুদ্রের তেতো জল।
ভয় পেয়ো না এই অপেক্ষা তো আমাদের স্বাধীনতার সোপান।
জেল থেকে যখন বের হই আমি তখন আরও ঋদ্ধ হয়েছি।
আমি বুঝেছি এই সংগ্রাম কেবলই কোনো অতীত নয় বরং
ভবিষ্যৎ ফসল ফলানোর বীজ।
আমার কথা শোনো, আঁকড়ে ধরে রাখো তোমাদের লালিত সম্মান, লেগে থাকো আর স্বপ্ন দেখো
জেনে রাখো স্বপ্নের মৃত্যু নেই।
শত্রুরা চায় আমাদের প্রতিরোধ ভেঙে যাক
তারা সন্ধির অন্তহীন ফাঁদ পাতে।
মনে রেখো এই ভূখ- এই দেশ তোমার কখনো হাতছাড়া করো না।
তারা প্রতিরোধ ভয় পায়
তারা চায় আমরা হাল ছেড়ে দেই, অথচ প্রতিরোধ আমাদের প্রাণ
যা বেঁচে থাকে আমাদের বিশ্বাসে দেশপ্রেম ভালোবাসায়।
যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে সেই শহীদদের রক্তের প্রতি বিশ্বস্ত থেকো
তারা তো নিজের রক্তে তোমাদের মুক্তির পথ মসৃণ করে গেছেন।
ষড়যন্ত্রের কূটচালে তাদের রক্ত বিসর্জন যেন ব্যর্থ না হয়।
তোমরা বলো আমাদের শুধু একটাই পথ যে পথে গেছেন আমার পূর্বপুরুষ
কোনো মূল্যেই তা বিকোবার নয়।
গাজা আমার হৃদয়ের স্পন্দন কখনো যা স্তব্ধ হবে না যদিও সকল পৃথিবী রুদ্ধ করেছে তাদের দুয়ার।
ভেবো না আমার নেতৃত্ব ছিল শুধু ক্ষমতার পালাবদল
বরং তা ছিল ঢিল থেকে জন্ম নেয়া রাইফেলের তপ্ত বুলেট।
আমি ছিলাম সেনাপতি তোমাদের ব্যথায় নিয়ত বিদ্ধ হয়েছি
আমি জানি আমাদের প্রতিটি বিজয় রক্তের অমূল্য দামে কেনা
কিন্তু হার মেনে নেয়ার মূল্য অনেক অনেক বেশি।
তোমরা তাই মাতৃভূমি আঁকড়ে ধরে রাখো
মাটি যেমন আঁকড়ে ধরে রাখে বৃহৎ মহিরুহ, তার গভীর শেকড়।
আল-আকসায় আমি শুধু যুদ্ধ করিনি
আমি ছিলাম প্রতিটি ফিলিস্তিনির মুক্তির গান
আমি স্বপ্ন দেখেছি নতুন একদিন নদীর মতন সব ঝর্ণাধারা যেখানে এসে মিলে যায়, যুদ্ধ করে হাতের মুঠোয় রেখে তাদের জীবন।
একটাই তো শত্রু আমাদের
শিশু আর বড়দের তফাৎও যাদের কাছে মূল্যহীন
আমি রেখে যেতে চাই স্বাধীন ফিলিস্তিন যেখানে নেই পুত্রহারা মায়ের ক্রন্দন আর শূন্যদৃষ্টি নিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে থাকা পিতার কোলে প্রাণহীন অবুঝ মেয়েটির লাশ
আমার ইচ্ছা শুধু প্রতিরোধ, আমি জানি কোনো প্রতিরোধই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে না
আর এটা তো শুধু গুলি ছোড়া নয় একটা জাতির সম্মান।
কারাগার আমাকে শিখিয়েছে মুক্তি সে তো দীর্ঘ বন্ধুর পথ
তবুও আমরা এখানে
আমাদের ভূমিতেই বাস করবো
এখানেই আমাদের হৃদয় আর অনাগত শিশুর সুতীব্র চিৎকার।
যে ভূমিকে আমি ভালোবেসেছি
সেই প্যালেস্টাইন আমি তোমাদের সঁপে দিলাম।
যেই স্বপ্নের ভার আমি পর্বতের মতো লালন করেছি সেই পর্বত আমি তোমাদের দিলাম।
আমি হারিয়ে গেলেও তোমরা হারিয়ে যেয়ো না বরং
দেশের পতাকা বয়ে নিয়ে যেয়ো যেন সেতুবন্ধন হয় ফিনিক্স পাখির মতো
ছাই থেকে জেগে ওঠা আমার রক্ত
আর অনাগত বংশধর।
মনে রেখো মাতৃভূমি কেবলই একটা গল্প নয় বরং একটা রক্তবীজ
শহীদের রক্ত থেকে এখানে জন্ম নেয় অযুত যোদ্ধা জীবন।
যদি কখনো আবার জোয়ার আসে
মনে রেখো আমি সেই জোয়ারের প্রথম ঢেউ আর
আমি তো এমনই দেখতে বেঁচেছিলাম
এই যুদ্ধ যেন চলে অবিরাম।
তোমরা বেঁচে থেকো তাদের গলার কাঁটা হয়ে আর হার মেনো না
যতক্ষণ পৃথিবী জানে আমরাই এই ভূখ-ের আসল অধিপতি
আমরা শুধু কেবলই মৃতের সংখ্যা নই।