আগামী ৫ নভেম্বর, ২০২৪ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে মার্কিন ভোটাররা যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট বেচে নিবেন। প্রার্থী মূলত: দু’জন – ডেমোক্র্যাট কমালা হ্যারিস আর রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ দু’জনের যে কোন একজনই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। আরো কয়েকজন প্রার্থী থাকলেও তাদের কেউই বিজয়ের ধারে কাছেও যেতে পারার সম্ভাবনা নেই। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয় শিবিরেই বিরাজ করছে উইন উইন সিচুয়েশন। বিশেষজ্ঞদের মতে এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।
জো বাইডেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী নির্বাচিত হবার পর রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় বাইডেনকে অনেকটা দুর্বল প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। মার্কিন নির্বাচন নিয়ে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন তাঁদের মধ্যে এ রকম একটা ধারণা প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে ২০২৪ ইংরেজি সালের নির্বাচনে বাইডেন হেরে যাবেন এবং ট্রাম্প আবারও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। এর পরই ডেমোক্রেটিক পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব ও সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে প্রার্থী পরিবর্তনের জোর দাবি উঠে। সিনিয়র ডেমোক্রেটরা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। তাঁরা বাইডেনকে প্রার্থিতা ছেড়ে দিতে রাজি করাতে সক্ষম হন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস নতুন প্রার্থী নির্বাচিত হন। ক্লিন ইমেজের ক্যারিশম্যাটিক লিডার কমালা হ্যারিস ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হবার পর ডেমোক্রেটদের হতাশা অনেকটা কেটে যায় এবং তাঁদের মধ্যে চাঙা ভাব তৈরি হয়। তাঁরা নতুন উদ্যমে কমালার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনায় ব্যাপকভাবে অংশ গ্রহণ করতে থাকে। এতে কমালার পক্ষে অনেকটা গণজোয়ার সৃষ্টি হয়।
অপরদিকে কর ফাঁকি, নানা কেলেংকারি, অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও উগ্র স্বভাব ইত্যাদি নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রিপাবলিকানরা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকেই তাদের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত করেছে এবং তাঁর পক্ষে জোরালো সমর্থনও রয়েছে।
কয়েক দিন আগে সিএনএনের এক জরিপে কমালা ও ট্রাম্প উভয়ের পক্ষে সমান সমান (৪৭%) সমর্থনের তথ্য উঠে আসে। সর্বশেষ আরেকটি জরিপে কমালার পক্ষে ৪৮.৩% এবং ট্রাম্পের পক্ষে ৪৭.৩% সমর্থন দেখা যায়। অর্থাৎ কমালা ট্রাম্পের চেয়ে ১% বেশি সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আছেন। নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন পূর্বে জনসমর্থনের এ রকম পূর্বাভাসগুলো তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতারই ঈঙ্গিত দিচ্ছে। নির্বাচনে ভোট দেবার জন্য যাঁরা ইতোমধ্যে মনস্থির করে ফেলেছেন তাঁরা তো তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকেই ভোট দিবেন। কিন্তু যেসব ভোটার এখনো দোদুল্যমান অবস্থায় আছেন সে সব ভোটার নির্বাচনের দিন কাকে ভোট দিবেন তার উপর ভিত্তি করেই কোন প্রার্থীর চূড়ান্ত বিজয় রচিত হবে।
মুসলমানদের মধ্যে দোদুল্যমানতা: যে-ই লাউ সেই কদু
এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেয়ার ব্যাপারে মুসলিম ভোটারদের মধ্যে চরম দ্বিধা-দ্বন্ধ ও দোদুল্যমানতা বিরাজ করছে। কারণ ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে অধিকাংশ মুসলিম ভোটার ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছিলেন এ-ই আশায় যে তাঁরা হয়তো মুসলমানদের অধিকার রক্ষা এবং মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে কিছুটা হলেও নমনীয় ও নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করবেন। কিন্তু ডেমোক্রেটদের কর্মকাণ্ডে মুসলমানদেরকে চরমভাবে হতাশ হতে হয়েছে। কারণ বর্তমান ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমলেই চরম আগ্রাসী রাষ্ট্র ইসরায়েল দানবীয় নৃশংসতা চালিয়ে ফিলিস্তিনের গাজাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। গাজার নিরীহ নিরস্ত্র মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুদেরকে প্রতিদিনই হত্যা করছে। এ কথা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে ফিলিস্তিনসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল দানবীয় আগ্রাসন ও হত্যাকাণ্ড চালাতে পারছে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থন, সম্মতি ও সার্বিক সহযোগিতার কারণে। আর এ কারণেই মার্কিন মুসলিম ভোটারগণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তাঁরা দেখেছেন ডেমোক্র্যাটদের আমলে যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণভাবে মুসলমানদের জন্য কিছুটা নমনীয় নীতি অবলম্বন করা হলেও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষতঃ ফিলিস্তিন নীতিতে ইসরায়েলের জন্য চরম পক্ষপাতিত্বমূলক নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। অপরদিকে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলেও মুসলমানরা চরম বৈষম্যমূলক মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির যেমন শিকার হয়েছেন তেমনি অভ্যন্তরীণভাবেও তাঁদেরকে অনেক হেনস্তা ভোগ করতে হয়েছে। নির্বাচনের আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ইতিমধ্যে “যা করা দরকার তা করার” অনুমতি বা সম্মতি দিয়ে রেখেছেন। (Do what you have to do) এতে অনুমান করা যায় কট্টরপন্থী ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যেমন মুসলমানদেরকে নানা ধরনের চাপের মধ্যে পড়তে হবে তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষতঃ ফিলিস্তিনের মুসলমানদের দুর্দশার কোন উন্নতি তো হবেই না বরং বৃদ্ধি পাবে। কারণ ট্রাম্পের অন্ধ সমর্থনের কারণে যুদ্ধবাজ ইসরায়েল তার আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। আর তাই অনেক সচেতন মুসলমান মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যিনিই নির্বাচিত হোন না কেন মুসলমানদের জন্য তিনি হবেন “যে-ই লাউ সেই কদু”! কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি সব সময়ই যুদ্ধবাজ ইসরায়েলের পক্ষেই থাকবে। এ অবস্থায় মুসলমানদের অনেকে ভোট দানে বিরত থাকার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।
আপাততঃ অন্য কোন বিকল্প না থাকলেও সচেতন মুসলিম নেতৃবৃন্দ মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম ভোটারদের নিস্পৃহ বা উদাসীন থাকার কোন সুযোগ নেই। সচেতনভাবেই তাঁদেরকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে এবং নির্বাচনগুলোতে ভোট দেওয়া এবং সম্ভব হলে প্রার্থী হিসেবে অংশ গ্রহণ করার মানসিকতা বাড়াতে হবে। তাতেই রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের গুরুত্ব বাড়বে এবং তাঁদের অধিকার আদায়ের সুযোগ ও সম্ভাবনা জোরদার হবে। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও মুসলমানদেরকে ব্যাপকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হবে এবং দুই “মন্দ প্রার্থী”র মধ্যে কিছুটা “কম মন্দ” প্রার্থী কমালা হ্যারিসকে ভোট দেয়ার কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এভাবেই হয়তো একদিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানগণ “একচোখা মার্কিন নীতি” পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে।
লেখক: মোহাম্মদ সফিউল আলম, নিউ ইয়র্ক
পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ