‘যুদ্ধকালীন চট্টগ্রাম ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের অদূরদর্শী নির্দেশনার কারণে মিরসরাই উপজেলা সদরের অছিমিয়া ব্রিজ এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ জন বাঙালি সেনা, ইপিআর ও আনসার সদস্য প্রাণ হারান।’ ১৯৭১ সালের বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এমন দাবি করেন মিরসরাইয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা জসীম উদ্দিন চৌধুরী। যুদ্ধকালীন বাঙালি আর্মি, ইপিআর ও আনসার সদস্যদের নিয়ে গড়া ১৩১ প্লাটুন গ্রুপের এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অল্প কিছুদিন পূর্বে কুমিল্লা সেনানিবাসে ফোর বেঙ্গল রিজিমেন্টে আমি একজন নতুন রিক্যুট সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিই। ওই সময় আমার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিন। মার্চের শুরুতে আমি ছুটিতে বাড়ি আসি। এপ্রিলের প্রথম দিকে আমাদের ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে সেনা, ইপিআর সদস্য ও আনসার মিলে প্রায় ১২ প্লাটুন সদস্য মিরসরাইয়ের বাদামতলী এলাকায় আসলে সেখানে আমিও আমার ক্যাপ্টেনের নির্দেশে যোগ দিই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সম্ভবত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া আমরাই প্রথম গ্রুপ ছিলাম। এপ্রিলের ১০ তারিখের দিকে আমাদের ক্যাপ্টেনের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনাদের রুখতে আমরা সীতাকু-ের কুমিরা এলাকায় ডিফেন্স নিই। এরপর পাকিস্তানিদের রুখতে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটে মিরসরাইয়ের বাদামতলী-ওয়ার্লেস এলাকা পর্যন্ত আমরা একটি ডিফেন্স তৈরি করি। এখানেও আমরা ব্যর্থ হয়ে পিছু হটে মাস্তান নগর এলাকায় সোনাপাহাড় নামক স্থানে পাহাড় ও টিলার আড়ালে অবস্থান নিই। কারণ আমাদের সবগুলো ডিফেন্সের চেয়ে এটা ছিলো উত্তম এলাকা। যেখানে কৌশল বাদলাতে যান ইপিআরের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন অলি আহম্মদ (কর্নেল অলি আহম্মদ বীর বিক্রম)। কিছুক্ষণ পর আমাদের ডিফেন্স এলাকায় যান তৎকালীন চট্টগ্রাম ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান।
একাত্তরের এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, হঠাৎ সেক্টর কামান্ডার (মেজর জিয়াউর রহমান) আমাদের ক্যাপ্টেন মতিনকে পিছু হটার কারণে উচ্চস্বরে শাসাতে লাগলেন। আমরা তখন সেনাবাহিনীতে নতুন। প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছিলাম না। পরে সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশে ক্যাপ্টেন পুনরায় আমাদের নিয়ে পূর্বের স্থানে অগ্রসর হতে লাগলেন। সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকা অগ্রসর হওয়ার পর মিরসরাই সদরের অছিমিয়া ব্রিজের ১০ মিটার উত্তরে হঠাৎ পাকিস্তান আর্মিরা আমাদের ওপর হামলা করে এবং বৃষ্টির মতো মর্টারসেল আর গুলি ছুঁড়তে লাগলো। এসময় আমাদের সাথে থাকা অন্তত ৬০-৭০ জন সেনা, ইপিআর ও আনসার সদস্য প্রাণ হারান। এটা নেহায়েত আমাদের সেক্টর কমান্ডের ভুল নির্দেশের কারণে ঘটেছে।
এপ্রিলের শেষের দিকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ওই ঘটনার পর আমরা মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট হয়ে রামগড়ের চিকনছড়া স্কুলে অবস্থান নিই। পরে আন্দার মানিক বর্ডার দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় বিএসএফ আমাদের ১২ জন সঙ্গীসহ আমাকে গ্রেপ্তার করে। পরে সিক্স বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমাদের বিএসএফ থেকে ছাড়িয়ে নেন এবং মে মাসে আমরা আগরতলা মতিনগর, পরে শ্রীনগর-হরিণা ক্যাম্পে পৌঁছাই। সেখানে দেখা হয় চট্টগ্রাম এক নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার মোশাররফ ভাই, সিএনসি জাফর ও মহিউদ্দিন রাশেদের সঙ্গে। তারা আমাকে সেখানে আর্মি সদস্য পরিচয় না দিয়ে পরে আসামের লায়ারপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠালে সেখানে দুই মাসের ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে এসে পুনরায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিই। এখানে আমাদের মিরসরাই দক্ষিণ অঞ্চল কমান্ডার সিএনসি জাফর ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার।
পূর্বকোণ/পিআর