যোগ্য বাংলাদেশি চাকুরীপ্রার্থী থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশিদের নিয়োগ দিচ্ছে। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল যে, বিদেশিদের নিযোগ দিলে তাদের প্রেস্টিজ বাড়ে। তাছাড়া বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং কাজ করানো উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক সহজ হয়।
দেশের লোকজনকে এই লেভেলে নিয়োগ করা হলে প্রতিষ্ঠানে পলিটিকস ঢুকে যায়। তাদের মধ্যে এ বোধটুকু কাজ করছে না যে, যদি দেশে একজন বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয় তবে একটি পরিবার দারিদ্রমুক্ত হয়। বিনিয়োগ বোর্ডের নীতিমালায় বলা আছে, একজন বিদেশি নিয়োগ দিতে হলে তার বিনিময়ে পাঁচজন বাংলাদেশি নিয়োগ দিতে হবে এবং নিযুক্ত বিদেশি নাগরিকের কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে বিদেশিকে বিদায় করে দিতে হবে। ড) সরকারী চাকরি প্রাপ্তিতে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস বাদে অন্যান্য ক্ষেত্রে যোগ্যতার বদলে উৎকোচ ও তদ্বিরই নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। চাকুরির জন্য পাঁচ থেকে পঁচিশ লাখ টাকা লেনদেনের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। ঢ) ২০১৯-২০ সালের বাজেটে তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে ’স্টার্টআপ’ নামে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত এর কার্যক্রম শুরু হয়নি।
উদ্যোক্তা হতে বাধাসমূহ : ক) নতুন ব্যবসা বা উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করতে অর্থসংস্থান সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোন সাপোর্ট সিস্টেম বা সহজবান্ধব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ‘ইজ অব ডুইং বিজনেস সূচক’ ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৬৮তম। খ) দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টাকারীর সংখ্যার তুলনায় সফল হওয়া কিংবা অন্তত পেট চালিয়ে নেয়ার মতো সফলতার দেখা পাওয়া উদ্যোক্তার সংখ্যা নগন্য। উদ্যোক্তা হওয়া বলতেই আমরা কেবল হাঁস-মুরগির খামার করা কিংবা অনলাইনে কিছু জিনিষপত্র বিক্রিকে বুঝি। এসবে আমাদের নিজস্ব প্ল্যান, জ্ঞান, পুঁজি না থাকায় বরাবরের মতো শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হই। তাই সমাজও এদেরকে ছোট করে দেখে। এমনকি সরকারি বেসরকারি সাহায্য, উপদেশ, ব্যাংক থেকে ঋণ খুব একটা পাওয়া যায় না।
শিক্ষিত বেকারত্বের কুফল:
ক) সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়া- একজন কর্মক্ষম মানুষ কাজ করার সুযোগ না পেলে একদিকে নিজে যেমন হতাশায় ডুবে যান, অন্যদিকে তেমনি তিনি পরিবার এবং দেশের বোঝা হিসেবে পরিগণিত হন। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সামাজিক অস্থিরতার আশংকা জোরদার হচ্ছে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা অর্থাৎ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করতেই একজন শিক্ষার্থীর জীবন থেকে ১৬ থেকে ১৮ বছর অতিবাহিত হয়। সেশনজট মিলিয়ে আরো তিন-চার বছর লেগে যায়। এরপর পরিবারের হাল ধরতে খুঁজতে হয় চাকুরি। দেশের গ্র্যাজুয়েট সংখ্যার চাইতে গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকুরির সুযোগ নগণ্য। যার দরুন গ্র্যাজুয়েটদের চাকুরির সময় প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই নিম্নমানের বেতন নির্ধারন করে। এর ফলে সেই গ্র্যাজুয়েটদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে একপ্রকার হীনমন্যতার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের চার পাশের ভাষা তাদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে, এর চেয়ে সবজি বিক্রি করে, অটোরিকশা চালিয়ে কিংবা বিদেশে শ্রমিক হিসাবে গায়ে গতরে খাটলে বেশি ভাল হতো।
খ) প্রবাসীরা আমাদের দেশে যত রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে তার কয়েকগুন বেশি টাকা বিদেশীরা বাংলাদেশ থেকে তাদের দেশে পাঠাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন কোম্পানী সহ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ বিদেশি কাজ করছে। এদের বেশির ভাগই কর্মকর্তা পর্যায়ের। তাদের একেক জনের বেতন পাঁচ বাংলাদেশি কর্মকর্তার মোট বেতনের চেয়েও বেশি। অর্থাৎ এক বিদেশি কর্মকর্তা পাঁচজন দেশীয় কর্মপ্রত্যাশীর জায়গা দখল করে রাখছে। এ হিসেবে বিদেশি কর্মকর্তা নিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশিকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সিপিডি এর গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ২ লাখ ভারতীয় কাজ করছে যারা বছরে ৩.৭৬ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, একদিকে আমাদের তরুণরা বিদেশে গিয়ে চরম প্রতিকূল পরিবেশে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশিরা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষিত বেকারত্ব রোধে করণীয়:
১) শিক্ষার্থীদের নিজেকে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্নভাবে গড়ে তোলা,
২) শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিকরা,
৩) আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী তরুণ জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত ও কারিগরীভাবে দক্ষ করে তোলা।
৪) কারিগরী শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভূক্ত করা। বিবিএ পড়া বা ইংরেশিতে বা ইতিহাসে অনার্স পড়া একজন শিক্ষার্থীকে যেকোন একটি কারিগরি বিষয়ে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
৫) প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা একটি কোর্স রাখলে ভাল হয়। যেখানে দক্ষ শিক্ষক দিয়ে শুধু চাকরির বিষয়ে পাঠ দান করা হবে। তাহলে একাডেমিক লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীরা অন্য বিষয়েও দক্ষ হয়ে উঠবে। কারণ দারিদ্রের কষাঘাতে পিষ্ট হয়ে চাকুরীর পস্তুতি নিতে অনেক হতদরিদ্রের সন্তান ব্যর্থ হয়।
৬) ইন্ডাস্ট্রিকে প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করা। সরকার প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট দিতে পারে, সবাই নির্দিষ্ট সংখ্যক নবীন গ্রেজুয়েটকে প্রতিবছর তিন থেকে ছয় মাসের জন্য ইন্টার্ন হিসাবে নিয়োগ দেবে। তাদের বেতন সরকার সরাসরি মোবাইল হিসাবে দিয়ে দেবে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো তরুণদের সুযোগ দিতে উৎসাহিত হবে। কারণ, এতে তাদের কোন খরচ হবে না। তাদের মূল দায়িত্ব হবে ‘অন দ্য জব’ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রশিক্ষিতদের অনেকেরই প্রশিক্ষণ শেষে সেই প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত চাকরি হতে পারে। এতে একদিকে যেমন প্রশিক্ষণের সমস্যার সমাধান হবে, অন্যদিকে অনেক নুতন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে।
৭) চাকুরির পরীক্ষাগুলো প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে নেয়া হলে বেকার শিক্ষিতরা দূরদূরান্ত থেকে ঢাকা যাওয়ার ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য যাত্রা থেকে রেহাই পাবে। একই দিনে একাধিক নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করতে হবে।
৮) শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকারদের ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে হবে।
৯) রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে।
১০) দেশে কর্মসংস্থান কমিশন গঠন করা জরুরি। এই কমিশন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করবে।
১১) জরুরিভাবে কোটা পদ্মতির সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশে সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশ বিভিন্ন প্রকার কোটা ও বাকি ৪৫ শতাংশ মেধাভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। কোটায় যে পোস্টগুলো থাকে বেশিরভাগ সময়ই সেগুলো পূরণ হয় না। ফলে সেগুলো ফাঁকাই থেকে যায়। উপযুক্ত প্রার্থী থাকা সত্বেও শুধুমাত্র কোটা না থাকার কারনে অনেকেই চাকুমশ পায় না।
১২) এসএমই ঋণের ব্যবস্থাপনাকে আরো সহজ করে দেশব্যাপী উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারকে আরো তৎপর হতে হবে।
১৩) আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল ও নারীশিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষঠী ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া।
১৪) রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। লণ্ঠনমূলক ব্যয় হিসাবে কতশত কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যায়, এর কোন খবর নেই। কেবল বেকারভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে টান পড়ে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য হতে পারে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে বেকার ভাতা প্রদান এবং বেকার সমস্যা দূরীকরনের পথ ও পন্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
উপসংহার: একদিকে কর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন ও সামঞ্জস্যহীন শিক্ষা ও সার্টিফিকেট, অন্যদিকে বৈষম্যপূর্ণ আর্থ-প্রশাসনিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা দেশের কর্মসংস্থানের স্বাভাবিক সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। জাতি এ পরিস্থিতির আশু সমাধান চায়। (সমাপ্ত)
লেখক: ডা. হাসান শহীদুল আলম, ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক চট্টগ্রাম।
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ