চট্টগ্রাম বুধবার, ০১ মে, ২০২৪

বিপন্ন পরিবেশ : নাগরিক করণীয়

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

২ জুলাই, ২০১৯ | ১:৪২ পূর্বাহ্ণ

মানুষের আবাসের জন্য, প্রাণীর প্রাণচাঞ্চল্যের জন্য, সবুজের ঘন-শ্যাম সমারোহের জন্য একটিই মাত্র গ্রহ। এই পৃথিবী। এই মাটির পৃথিবী, পানির পৃথিবী, বাতাসের পৃথিবী, সবুজের পৃথিবী। জীবনের জন্য একটিই নির্ভরতা- আমাদের এই প্রাণপ্রিয় পৃথিবী। মাটি, পানি, বাতাস প্রাণের পৃথিবীকে রেখেছে পরিপূর্ণ করে প্রাণের চাষবাসের জন্য। এদের নিবিড় পরশে-সরসে প্রাণ বিকশিত হয়েছে। প্রাণের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। প্রাণ থেকে প্রাণে, জীবন থেকে জীবনে প্রাণ স্থানান্তরিত হয়েছে।
হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় পৃথিবীতে জীবনের বিকাশ, বিস্তৃতি ঘটেছে। পৃথিবীর বয়স বেড়েছে। পৃথিবীর আয়ূ কমেছে। ঊদ্ভিদ-প্রাণির বহুমাত্রিক প্রজাতির নান্দনিক পৃথিবীতে দুর্যোগ, দুর্ভোগ-দুর্বিপাক বেড়েছে। বেড়েছে এদের সংখ্যা ও মাত্রা। প্রাকৃতিক ও কৃত্তিম দুর্যোগ পৃথিবীকে ধীরে ধীরে সংকটাপন্ন করে তুুলছে। প্রাণি-ঊদ্ভিদকূলের জন্য, মানুষের জন্য, পৃথিবীর নিজের অস্থিত্বের জন্য পৃথিবী এখন মহাসংকটাপন্ন। সংকটের ঘণীভবন পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। পৃথিবীর সাথে তার একমাত্র আশ্রয়ী প্রাণের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। প্রাণ-সম্পদের অতি ব্যবহারে, সবুজের নিধনে,জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত দহনে পৃথিবী জলন্ত উনুনে পরিণত হতে চলেছে। নিঃস্ব হতে চলেছে পৃথিবী- সম্পদে, সম্ভারে, সত্তায়-স্বকীয়তায়।
বিশ্বময় সবুজ সংকোচনশীল। বন কমে যাচ্ছে। উদ্ভিদ প্রজাতির দ্রুত বিলুপ্তি ঘটছে। দেশে দেশে সবুজ গাছগাছালি নিধনযজ্ঞ চলছে। উন্নয়ন উষ্ণায়ণকে উস্কে দিচ্ছে। সবুজের সংকটে বৃষ্টিবাদলের ধারাপাত বিঘিœত হচ্ছে। তাপমাত্রা বাড়ছে। ঋতুবৈচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তীব্র তাপদাহে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে প্রাণহানি ঘটছে। পৃথিবীর তাপ অসহিষ্ণুতা বিভিন্নভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। পৃথিবী তার অসামর্থকে নানানভাবে জানান দিচ্ছে।
পানি দূষণে আক্রান্ত। এটি সীমিত সম্পদ। অতি ব্যবহারে, অপব্যবহারে বিশ্বময় এটি সংকোচনশীল। ক্রমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বহুজাতিক কোম্পানি সমূহের পণ্যে পরিণত হতে চলেছে জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এ অমূল্য সম্পদ পানি। ভোগ-বিলাসি মানুষের পানির অপব্যবহার, অপরিকল্পিত শিল্পে, রসায়নে পানি নীতির অনুপস্থিতি, অবাঞ্চিত ও অনাকাক্ষিত নিয়ন্ত্রণ পানিকে দুষ্প্রাপ্য পণ্যে পরিণত করছে। পানিনির্ভর জীবন বিপদাপন্ন হচ্ছে। অথচ সারা দুনিয়ায় এ অমূল্য সম্পদটিকে অস্বীকার করে বা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। পানি পৃথিবীতে জীবনকে বিকশিত করছে, জীবনকে প্রাণ দিচ্ছে, জীবনকে বিপর্যস্ত করছে। এ জন্যে এই পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে ঊনচল্লিশ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে পানিবাহিত রোগে। পানিবাহিত রোগ ডায়েরিয়ায় মরছে সমগ্র বিশ্বে প্রায় এগার লক্ষ প্রাণ। সাত শত ষাট কোটি মানুষের এ গ্রহে এখনও প্রায় একশত দশ কোটি মানুষ সুপেয় পানি অধিকার থেকে বঞ্চিত। এর যতটুকু নয় পানির জন্য, তার চেয়ে বেশী অব্যবস্থাপনার জন্য। সুতরাং অত্যন্ত সচেতনভাবে অপচয় রোধের জন্য আজ ও আগামিতে আমাদের প্রতিশ্রুতি কী হওয়া উচিত- তা নির্দিষ্ট করা জরুরি।
বাতাস কার্বনসহ বহুমাত্রিক রাসায়নিকের বিষ দূষণে আক্রান্ত। প্রকৃতির এ অমূল্য সম্পদটি বিষ-শোষকের অন্যতম প্রধান সিংকে পরিণত হচ্ছে। বাতাসকে অনিচ্ছায় ধারন করতে হচ্ছে তার জন্যে ক্ষতিকারক বহুমাত্রার বিষ উপাদান-সালফার, কার্বন, নাইট্রোজেনের গ্যাস ও কণা উপাদানসহ জীবাশ্ম জ্বালানির বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, ইলেকট্রনিক সামগ্রি থেকে উৎসারিত ক্লোরোফ্লোরো কার্বনের অনিরাময়যোগ্য বিষ-গ্যাস। বাতাসে এমন সব গ্যাসের সংমিশ্রণ আমরা ঘটাচ্ছি, যা দেড় থেকে দুশ’ বছর পর্যন্ত জীবনের ক্ষতি করে যাবে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। বাতাসকে আমরা বিষাক্ত করছি, ভারি করছি। শিল্পসমৃদ্ধ দেশের শিল্পবিলাসের দূষণ আমরা গ্রহণ করে বিষিয়ে উঠছি। ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধ না করেও আমরা শাস্তি ভোগ করছি। আর এই বাতাসকে বিষমুক্ত রাখার জন্য আমাদের কতোই না প্রচেষ্ঠা। ব্রাজিলের রিওডি জেনেরিও থেকে আওয়াজ তুলে আমরা কিয়োটোতে এসেছি। মিলেছি-বলেছি-শুনেছি-গিলেছি-ভুলেছি। আমাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছি। মেনেছি, মানিনি। বালি থেকে বিভিন্ন পথ ধরে আমরা কোপেনহেগেন হয়ে কানকুন, ডারবান চষেছি। বিভিন্ন হিসাব কষেছি। দোহা- ওয়ারশে বসেছি। বিশাল হৃদয়কে টলাতে, ভোলাতে পারিনি। নিরাশ হয়েছি, হতাশ হইনি। অধির আগ্রহ নিয়ে গিয়েছি প্যারিসের। শুনেছি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনে বিশ্বে পঞ্চম দেশ জাপান ২০৩০ সালের ভিতর গ্রীন হাউস গ্যাস ২০০৫ সালের তুলনায় শতকরা বিশ ভাগ কমিয়ে আনতে চায়। আরবিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বারের মতো তা কমিয়ে শতকরা আটাশ ভাগে আনতে চেয়েছে ২০২৫ সালেই। অবশ্য ইউরোপিয় ইউনিয়ন চেয়েছে আরও বেশী। তারাও ২০৩০ সালনাগাদ এ গ্যাস নির্গমন শতকরা চল্লিশ ভাগ কমানোর পক্ষে। এতো দিনে হয়তো ধরিত্রি সম্মেলনের একটি যৌক্তিক সফলতা খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশা জেগেছিল। আমরা অপেক্ষা করেছি। কাংক্ষিত ফল আসেনি। আমরা অপেক্ষা করছি। পরিবেশের বিশ^ আসরগুলো আমাদের আশা ভঙ্গ করেছে বারবার। কিন্তু আমরা এ উপলব্ধি করছি, পথ আমাদের খুঁজে নিতেই হবে।
মাটি জীবনের জন্য অন্যতম নির্ভরতা। উদ্ভিদের জন্য, উপকারি কীটপতঙ্গের জন্য, শস্যের জন্য, আবাসের জন্য। মাটি তাপ শোষণ করে আমাদের প্রাণের পৃথিবীকে শীতল রাখতো। বৃষ্টির পানির পুনর্ভরণ করে পানি ধারন করতো, পৃথিবীকে সজীব-সরস রাখতো। মাটি কোনভাবেই এ কাজটি আর করতে পারছে না। কেননা, মাটিকে কার্পেটিং করে আমরা ঢেকে দিচ্ছি। তার সে যোগ্যতাকে আমরা হরণ করেছি। মাটি আর প্রাকৃতিক থাকতে পারছে না। এসম্পদটিও রসায়ন এবং মানুষসৃষ্ট বিষ গিলে গিলে বিষময় হয়ে যাচ্ছে বিশ্বময়।
এভাবেই সারা দুনিয়ার পাহাড়, সাগর, নদী-খাল, বিল-ঝিল প্রাকৃতিক তা হারাচ্ছে। বন্যসম্পদ, জলজসম্পদ, স্থলজ প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রাণের ওপর মানুষের বিস্তৃত হাত এদের লুণ্ঠন করছে, নি:শেষ করছে। এমনি আর্থসামাজিক আন্তর্জাতিক একটি অবস্থায় আমাদের সন্তানদের জন্য আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ঘনত্ব কেমন হওয়া দরকার। আমাদের উৎপাদন এবং ভোগের ধরন যদি আমরা এখনকার মতোই অপরিবর্তিত রাখি, তবে জনসংখ্যার বর্তমান বৃদ্ধি প্যাটার্নে ২০৫০ সালে এসে প্রায় নয়শত ষাট কোটি মানুষের জন্য এরকম আরও তিনটি পৃথিবীর দরকার হবে। অসম্ভব এ অবস্থাকে কীভাবে উৎরানো যাবে? আসুন, আমরা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতে কথা ভাবি। তারাতো এ গ্রহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আমরাও আমাদের ভোগের ধরন বদলাই। সংরক্ষণ করি প্রকৃতির মূলধন, অমূল্য সম্পদ পানি, বাতাস, মাটি এবং জীবনের জন্য বাকি সব।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, কর্ণফুলি গবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট