চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অর্থপাচার, সেকেন্ড হোম ও ঋণ খেলাপীর দিনকাল

২৫ মে, ২০১৯ | ১:১৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচারের ঘটনা ও পরিমাণ অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে গেছে। বৈধ ও অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই পাচার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। পাচারকৃত এ অর্থের গন্তব্যে পরিণত হয়েছে কর অবকাশসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদানকারী দেশগুলো। এজন্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমকে। সোমবার দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, পণ্য আমদানীর নামে ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) করে মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে, কিন্তু সেই পণ্য আসছে না। আসছে খালি কন্টেইনার, মাটি, ইট, পাথর, ছাই, পানি। কিন্তু এভাবে অর্থ পাচারের ঘটনা বারবার সামনে আসলেও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। পরিণামে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে অর্থ পাচারকারীরা। অর্থ পাচারের এমন চিত্র খুবই উদ্বেগকর।
পূর্বকোণের প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারের ভিতরের পণ্য সঠিকভাবে পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে ২৫টি স্ক্যানার। কিন্তু এর বিপরীতে রয়েছে মাত্র কয়েকটি পুরনো স্ক্যানার। আর এটাকে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে অর্থ পাচারকারীরা। প্রশ্নটি হচ্ছে, এই অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রটি কার স্বার্থে কেনা হচ্ছে না। টাকার অভাব, নাকি অর্থ পাচারকারীদের স্বার্থ রক্ষা? এতে যে কাস্টম হাউজের দুর্নীতিবাজচক্রের যোগসাজস রয়েছে তা কি উড়িয়ে দেয়া যায়? সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, একটি প্রতিষ্ঠান এলসি করেছিল সরিষা বীজ আমদানির। পরিবর্তে এসেছে ৪৩টি খালী কন্টেইনার। ২৬টন তামা আমদানির এলসি করে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান এনেছে পাথর। আরেকটি প্রতিষ্ঠান এলুমিনিয়াম স্ক্যাপ আমদানির এলসি করলেও কন্টেইনারের পাওয়া গেছে ছাইয়ের অস্তিত্ব। অপর একটি প্রতিষ্ঠান ৩২০ ড্রাম সয়াবিন তেল আমদানির ঘোষণা দিলেও কন্টেইনারে পাওয়া গেছে পানি। এভাবে ভুয়া এলসি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানির নামে অর্থ পাচার করে যাচ্ছে। তবে নানা কারণে অর্থ পাচারের প্রায় ৯৫ ভাগ ঘটনাই অজানা থেকে যায়। ধরা পড়ে আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের মাত্র ৫ ভাগ ঘটনা। আবার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মুদ্রাপাচার আইনে মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত মামলার ভাগ্য কি হয় তা দেশবাসীর জানার সৌভাগ্য হয় না। আখেরে অর্থ পাচারকারীদের ভাগ্যই সুপ্রসন্ন হয়। কিন্তু বিপরীতে চরম ক্ষতির শিকার হয় দেশ এবং জাতীয় অর্থনীতি।
সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপী ঋণের পরিমাণ জ্যামিতিক হারেই বেড়ে চলেছে। নানা অনুসন্ধানী রিপোর্ট বলছে খেলাপীঋণের প্রায় ৯৫ শতাংশই পণ্য আমদানীসহ নানা কৌশলে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৬ হাজার ৩০৯ কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বলা যায়, এক অর্থ বছরের বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে আছে। কানাডায় বাংলাদেশি ধনীদের আবাস ‘বেগমপাড়া’ গড়ে উঠেছে পাচারকৃত অর্থে। অনেকে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন। ধারণা করা যায়, সুইস ব্যাংকে জমা অর্থ এই পাচার হওয়া অর্থেরই অংশ। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক’(এসএনবি) থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশী নাগরিকদের জমা টাকার পরিমাণ জ্যামিতিক হারেই বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ থেকে যদি এত অর্থ পাচার হয় এবং বছরের পর বছর তা নির্বিঘেœ চলতে থাকে, তাহলে তো দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। টাকা পাচারের এ প্রবণতা জাতীয় অর্থনীতির জন্যও মারাত্মক হুমকি। টেকসই উন্নয়নের বড় বাধা। অর্থপাচারের ঘটনা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের হার দ্রুত হ্রাসকরণসহ নানা ক্ষেত্রে হতাশা দেখা দেবে।
সংগতকারণে এ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, আমলা যারাই অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকুন না কেন, তারা দেশের অনিষ্টকারী। তাদের প্রতি সদয় হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা ভুয়া এলসি করে আমদানীর নামে বা অন্য কৌশলে অর্থপাচার করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানই কাম্য। এর সাথে যারা যুক্ত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা দরকার। একইসঙ্গে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতেও চাই সরকারের আইনানুগ, কার্যকর পদক্ষেপ। দেশের ব্যাংকগুলোর উন্নয়ন ও দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতেও নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ, যাতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের পুঁজি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে না হয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট