চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

নামাজের আগেই ফিতরা আদায় ওয়াজিব

ঈদে দামি নয়, সুন্দর-পরিষ্কার পোশাক পরা উত্তম

২১ এপ্রিল, ২০২৩ | ১:৪৫ অপরাহ্ণ

সব জাতিরই নির্দিষ্ট কিছু উৎসব রয়েছে। জাহেলি যুগেও আরবে নওরোজ ও মেহেরজান নামে দুটি উৎসব ছিল। আল্লাহপাক মুসলমানদের এর চেয়ে অধিক উত্তম দুটি উৎসব উপহার দেন। আর তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মীয় উৎসবের প্রথমটি ঈদুল ফিতর। আরবি ঈদুল ফিতর শব্দের অর্থ ‘রোযা ভাঙার দিন’। আবার একে ‍ইয়াউমুল জাএজ‍, অর্থ- পুরস্কারের দিবস হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস রোযা রাখা বা সিয়াম সাধনার পর মুসলমানেরা এই দিনটি ধর্মীয় কর্তব্যপালনসহ খুব আনন্দের সাথে পালন করে থাকে। আর দ্বিতীয়টি হলো ঈদুল আযহা। দুটো ঈদ আনন্দের সাথে পালন মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। নবীজি (সা.) বলেন, প্রত্যেক জাতির উৎসব আছে, আমাদের উৎসব হলো এই দুই ঈদ।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)থেকে বর্ণিত, হাদিস। বাজারে বিক্রয় হচ্ছিল এমন একটি রেশমী জুব্বা নিয়ে উমর (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট গেলেন। এবং তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি এটি কিনে নিন। ঈদ ও প্রতিনিধিদলের সাক্ষাতের সময় এটি দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বললেন, এই দামি পোশাক যার পরকালে তার কোন অংশ নেই। এই ঘটনার পর উমর (রা.) আল্লাহর যত দিন ইচ্ছা ছিল ততদিন অতিবাহিত করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তার নিকট একটি রেশমী জুব্বা পাঠালেন। উমর তা গ্রহণ করলেন এবং সেটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট এসে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনিতো বলেছিলেন, এ হচ্ছে তাদের পোশাক যাদের পরকালে কোন অংশ নেই । এতদসত্বেও এ জুব্বাটি আপনি আমার কাছে পাঠিয়েছেন! রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন,তুমি ওটা বিক্রি করে দাও এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করো। ইসলামে নতুন পোশাক পরিধান করার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বিভিন্ন দেশে তা বহুল প্রচলিত একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে। তাই নবীর শিক্ষা ঈদে দামি পোশাক নয়, সুন্দর, পরিষ্কার পোষাক পরা উত্তম।

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ঈদ পালন করা হয় দ্বিতীয় হিজরি বর্ষের বদরের বিজয়ের ১৩দিন পর পহেলা শাওয়াল। যা ছিল প্রথম ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ উদযাপন। একই বছর মদীনার সুদখোর মহাজন ইহুদি বনুকাইনুকা সম্প্রদায়কে নিরস্ত্র করার পর ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালন করা হয়।

ঈদের নামাজ পুরুষদের জন্য ওয়াজিব। ফযরের নামাযের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর ঈদুল ফিতরের নামাযের সময় হয়। এই সময় হলো সূর্যোদয়ের পর থেকে দিবসের মধ্যভাগের আগ পর্যন্ত। এই নামাজের জন্য আজান ও ইকামত দিতে হয় না। সকাল বেলায় এই নামাজ পড়া হয়। রমজানের ঈদ অপেক্ষা কোরবানি ঈদে জামাত একটু আগেই করা হয়। কারণ, তার পরে কোরবানি পশু জবাই সহ নানা কাজ থাকে। রমজানের ঈদের নামাজের আগে এবং কোরবানি ঈদের নামাজের পরে প্রাতরাশ গ্রহণ করা সুন্নত। ঈদের নামাজ একাকী আদায় করা যায় না। দুই রাকায়াত ঈদের ওয়াজিব নামাজ ছয়টি অতিরিক্ত ওয়াজিব তাকবিরসহ আদায় করতে হয়। ইমাম কর্তৃক শুক্রবারে জুম্মার নামাজের পূর্বে খুৎবা প্রদানের বিধান থাকলেও ঈদের নামাজের ক্ষেত্রে তা নামাজের পরে প্রদান করার নিয়ম ইসলামে রয়েছে। ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে খুৎবা প্রদান ইমামের জন্য সুন্নত; তা শ্রবণ করা নামাযীর জন্য ইসলামে ওয়াজিব।

মুসলমানদের বিধান অনুযায়ী ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে একটি খেজুর কিংবা খোরমা অথবা মিষ্টান্ন খেয়ে রওনা হওয়া সওয়াবের কাজ। ঈদুল ফিতরের ব্যাপারে ইসলামী নির্দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে গোসল করা, মিসওয়াক করা, আতর-সুরমা লাগানো, এক রাস্তা দিয়ে ঈদের মাঠে গমন এবং নামাজ-শেষে ভিন্ন পথে গৃহে প্রত্যাবর্তন। এছাড়া সর্বাগ্রে অযু-গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার বিধানও রয়েছে।
রমযান মাসের রোযার ভুলত্রুটির দূর করার জন্যে ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করার নাম ফিতরা। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ পড়া হয়ে গেলেও ফিতরা আদায় করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। ফিতরার ন্যূনতম পরিমাণ ইসলামি বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট। সাধারণত ফিতরা নির্দিষ্ট পরিমাণ আটা বা অন্য শস্যের-যেমন: যব, কিসমিস এসবের মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়। সচরাচর আড়াই সের আটার স্থানীয় মূল্যের ভিত্তিতে ন্যূনতম ফিতরার পরিমাণ নিরূপণ করা হয়। ইসলামে নিয়ম অনুযায়ী, যাকাত পাওয়ার যোগ্যরাই ফিতরা লাভের যোগ্য।

এ বছর বাংলাদেশে ফিতরার হার জনপ্রতি সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা ও সর্বোচ্চ দুই হাজার ৬৪০টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় ফিতরা নির্ধারণ কমিটি এ হার নির্ধারণ করেছে। শরীরের জাকাত সদকাতুল ফিতর। এটি আদায় করলে রমজান মাসের ভুলের কাফ্ফারা হয়ে যাবে। উত্তম. মধ্যম, নিম্ন আয় অনুযায়ী আপনাকে ফিতর আদায় করতে হবে। আপনি ধনী হয়ে যদি সর্বনিম্ন ৭৫ টাকা ফিতরা আদায় করেন তা সহীহ হবে না। সামর্থ্য অনুযায়ী আপনাকে ফিতরা আদায় করতে হবে।

ঈদের আগের রাতটিকে ইসলামী পরিভাষায় লাইলাতুল জায়জা অর্থাৎ পুরস্কার রজনী এবং আমাদের ভাষায় “চাঁদ রাত” বলা হয়। শাওয়াল মাসের চাঁদ অর্থাৎ সূর্যাস্তে একফালি নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদ হয়, এই কথা থেকেই চাঁদ রাত কথাটির উদ্ভব। ঈদের চাঁদ স্বচক্ষে দেখে তবেই ঈদের ঘোষণা দেয়া ইসলামী বিধান। আধুনিক কালে অনেক দেশে গাণিতিক হিসাবে ঈদের দিন নির্ধারিত হলেও বাংলাদেশে ঈদের দিন নির্ধারিত হয় দেশের কোথাও না-কোথাও চাঁদ দর্শনের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে। দেশের কোনো স্থানে স্থানীয় ভাবে চাঁদ দেখা গেলে যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে ঈদের দিন ঠিক করা হয়। চাঁদ রাতও ইবাদতের রাত। দামি রাত। ওইরাতে আমরা অনেকে মার্কেটে সময় কাটাই। ঈদের দিনের মতো রাতও দামি। বেশি সময় ইবাদতে কাটানোর চেস্টা করা উচিত।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)থেকে বর্ণিত, হাদীস।নবী করিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দু’রাকায়াত নামাজ পড়লেন। এর আগে বা পরে কোন নামাজ পড়লেন না। অতপর তিনি বিলালকে সাথে নিয়ে মহিলাদের নিকট গেলেন এবং তাদেরকে ( আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে) দানের জন্য বললেন। তখন তারা দান করতে শুরু করলো; কেউ দিল সোনা বা রূপার আংটি আবার কেউবা দিল গলার হার।

ঈদের দিন প্রথমে ফজরের নামাজ আদায় করতে হবে।কারণ, এই ফরজ নামাজ কোন মতে ছাড়া যাবে না। তারপর সকালে ওয়াজিব ঈদের নামাজের প্রস্তুতি নিতে হবে। সর্বাগ্রে অযু-গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া দরকার। এরপর আনুষ্ঠানিকতা হলো নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া। ঈদের নামাজ সবার জন্য। নামাজের পর সবাই একসাথে হওয়া, দেখা করা। ঈদের দিনে সালামি গ্রহণ করা প্রায় সব দেশেই রীতি আছে। তবে এর ধর্মিয় কোন বাধ্যবাধকতা বা রীতি নেই। সাধারণত: ঈদের নামাজের পরে মুসলমানরা সমবেতভাবে মুনাজাত করে এবং একে অন্যের সাথে কোলাকুলি করে ঈদের সম্ভাষণ বিনিময় করে থাকে।

এক ঈদের দিন মহানবী (সা.) রাস্তার পাশে একটি ছেলেকে কাঁদতে দেখেন। তিনি তার কাছে যান। ছেলেটি বলল, তার মা ও বাবা কেউই নেই। মহানবী (সা.) ছেলেটিকে তাঁর ঘরে নিয়ে আসেন। বললেন, আমি তোমার পিতা, আর আয়েশা তোমার মা। ফাতেমা তোমার বোন আর হাসান-হোসাইন তোমার খেলার সাথী। মহানবী (সা.) ছেলেটিকে সন্তানের মর্যাদা দান করেন। এভাবে মহানবী (সা.) ঈদের দিন অসহায়দের সহায়তা দান করতেন। আল্লাহপাক আমাদের মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের মতো ঈদ উদযাপন করার তৌফিক দিন।

ঈদের দিনে আমাদের সেমাই সবচেয়ে প্রচলিত খাবার। এবং বিশেষ আরো অনেক ধরনের খাবার ধনী-গরিব সকলের ঘরে তৈরি করা হয়। এ উৎসবের আরো একটি রীতি হলো আশেপাশের সব বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। এবং প্রত্যেক বাড়িতেই হালকা কিছু খাওয়া। এ রীতি দেশে প্রায় সবাই-ই মেনে থাকে। তবে ভেজালের কারণে সেমাই কম খাওয়াই উত্তম। সবশেষে বলা যায়-আমাদের ঈদের বিশেষ শুভেচ্ছাসূচক সম্ভাষণটি হলো, ‘ঈদ মুবারাক’।

 

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট