চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আজ বিশ্ব ফ্যামিলি ডাক্তার দিবস

ফ্যামিলি ডাক্তার দিবসের ভাবনা

আহমেদ শরীফ শুভ

১৯ মে, ২০২০ | ৩:৪১ পূর্বাহ্ণ

আজ বিশ্ব ফ্যামিলি ডাক্তার দিবস। ২০১০ সাল থেকে সারা পৃথিবীর ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান/জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের সংগঠন ওনকা (ডঙঘঈঅ)’র উদ্যোগে প্রতি বছর ১৯ শে মে দেশে দেশে বিশ্ব ফ্যামিলি ডক্টর দিবস পালিত হয়ে আসছে। সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা যথাযথ ট্রেনিংপ্রাপ্ত জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের ভূমিকা তুলে ধরা ও জনমনে সচেতনতা বৃদ্ধিই এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য। বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষিতে এবারের ফ্যামিলি ডাক্তার দিবসের স্লোগান- ‘ফ্যামিলি ডাক্তার সামনের সারির যোদ্ধা’। কারণ, এই ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা জেনারেল প্র্যাকটিশনাররাই সবচেয়ে প্রথম রোগীর সংস্পর্শে আসেন। বাংলাদেশে সঠিক রেফারেল পদ্ধতি ও পাশ্চাত্য ধাঁচের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিন্যাস গড়ে উঠেনি বলে যদিও অনেক ক্ষেত্রেই কোভিড-১৯ কিংবা অন্য কোন রোগের বেলায় রোগীরা ফ্যামিলি ফিজিশয়ানদের সংস্পর্শে না এসেই অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন। তবে উন্নত ও অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের চিত্রটি ভিন্ন। সেসব ক্ষেত্রে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা প্রশিক্ষিত জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের চেম্বারই রোগীর প্রথম গন্তব্য। রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রথম সারিতে থাকেন তারা।
বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিন্যাসের প্রেক্ষাপটে এবারের বিশ্ব ফ্যামিলি ডাক্তার দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আমাদের দেশে ফ্যামিলি মেডিসিন কিংবা জেনারেল প্র্যাকটিস আজও একটি বিশেষায়িত ডিসিপ্লিন হিসেবে গড়ে উঠেনি। চিকিৎসা পেশার এই শাখাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়ার ব্যাপারে ডাক্তারদের অনীহার এটি অন্যতম প্রধান কারণ। সেই সাথে জনসাধারণের মধ্যে ফ্যামিলি মেডিসিন বিষয়ে সচেতনতার অভাবও তার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
ফ্যামিলি মেডিসিন সম্পর্কে আমাদের ধারণা অস্পষ্ট। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশে ‘ফ্যামিলি মেডিসিন’, ‘ফ্যামিলি প্র্যাকটিস’ এবং ‘জেনারেল প্র্যাকটিস’ টার্মগুলোকে অদল-বদল করে ব্যবহার করা হয়। মূলতঃ এগুলো একই ডিসিপ্লিনের ভিন্ন ভিন্ন নাম। কিন্তু বাংলাদেশে জেনারেল প্র্যাকটিস সম্পর্কে জনমনে যে ধারণা আছে তা এবং উন্নত বিশ্বের ফ্যামিলি প্র্যাকটিস বা জেনারেল প্র্যাকটিস পুরোপুরি এক নয়। বাংলাদেশে মোটামুটি তিন ধরনের জেনারেল প্র্যাকটিশনার আছেন। প্রথমতঃ যারা জেনে-বুঝে সুচিন্তিতভাবেই জেনারেল প্র্যাকটিসকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ জেনারেল প্র্যাকটিস বা সম্পর্কিত কোন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও নিয়েছেন। তাদের আমরা বিশেষজ্ঞ জেনারেল প্র্যাকটিশনার কিংবা ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বলতে পারি। কিন্তু এ ধরনের বিশেষজ্ঞ জেনারেল প্র্যাকটিশনারের সংখ্যা দেশের চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। দ্বিতীয় ধারায় আছেন যারা কোন উচ্চতর ডিগ্রি করার অপেক্ষায় আছেন, বিভিন্ন স্নাতকোত্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির অপেক্ষায় আছেন বা অধ্যয়নরত আছেন। তারা উচ্চতর ডিগ্রি লাভের পর অন্য কোন বিশেষায়িত বিভাগে (কার্ডিওলজি, মেডিসিন, সার্জারি ইত্যাদি) প্র্যাকটিস করবেন। তারা সংগত কারণেই জেনারেল প্র্যাকটিস বা ফ্যামিলি মেডিসিনকে স্থায়ী ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে পারেন না এবং পড়াশুনা ও প্রশিক্ষণের চাপের কারণে তাদের জেনারেল প্র্যাকটিসের প্রতি দীর্ঘমেয়াদী দায়বদ্ধতার কমতি থাকতে পারে। কেউ কেউ আবার উচ্চতর ডিগ্রি লাভের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে জেনারেল প্র্যাকটিসকে স্থায়ী ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের যেহেতু এটা প্রথম পছন্দ ছিল না, সে জন্য এই ক্যারিয়ার এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যেও প্রথমদিকে জড়তা দেখা দিতে পারে। তৃতীয় ধারায় আছেন যারা বিভিন্ন পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কারণে দীর্ঘ মেয়াদে নিজের শহর ছেড়ে ঢাকা বা চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ নিতে যেতে পারেন না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, খুব কমসংখ্যক ডাক্তারই প্রথম পছন্দ হিসেবে জেনারেল প্র্যাকটিসকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেন।
তাদের মধ্যে ফ্যামিলি মেডিসিন বা জেনারেল প্র্যাকটিসে উচ্চশিক্ষা নেয়ার সংখ্যা আরো কম। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের জেনারেল প্র্যাকটিস যাচাইয়ের কষ্ঠিপাথরে মানোত্তীর্ণ নয়। সবাইকে অবশ্যই এক গোত্রে ফেলা যাবে না। দেশে অনেক দক্ষ ও যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান আছেন যাঁদের দক্ষতা, পেশাগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রশ্নাতীত। তবে আমাদের দেশে পূর্বে বর্ণিত দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধারার জেনারেল প্র্যাকটিশনারের সংখ্যাই বেশি। তাদের পক্ষে যুগের চাহিদার সাথে তাল মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। যেহেতু বাংলাদেশে প্র্যাকটিস অব্যাহত রাখার জন্য বিষয়ভিত্তিক পড়াশুনা (কন্টিনিউয়িং মেডিকেল এডুকেশন)’র বাধ্যবাধকতা নেই, তাই এই শ্রেণির প্র্যাকটিশনাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের দক্ষতা ও পেশাগত জ্ঞান হালনাগাদ করার জন্য নিয়মিত কোন প্রশিক্ষণ কিংবা বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অংশ নেন না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা পেশাগত জ্ঞানের হালনাগাদ করার জন্য মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের দেয়া তথ্য-উপাত্তের উপর নির্ভর করেন, যা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। ফলে তাদের কারো কারো মধ্যে হীনমন্যতা ভর করাও বিচিত্র নয়। আর দক্ষ জেনারেল প্র্যাকটিশনারের অপ্রতুলতার কারণে এই ডিসিপ্লিনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার অভাবও দেখা যায়। জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের বোঝাতে অনেকেই ‘সিম্পল এমবিবিএস’ কথাটি ব্যবহার করেন। অর্থাৎ, তারা ধরেই নেন যে জেনারেল প্র্যাকটিশনারমাত্রই শিক্ষাগত যোগ্যতা এমবিবিএসে শেষ হয়েছে।
উন্নত বিশ্বে ফ্যামিলি বা জেনারেল প্র্যাকটিসের ব্যাপারটি এমন নয়। সেসব দেশে এমবিবিএস পাশ করার পর ইন্টার্নশিপ শেষ করে যে কেউ জেনারেল প্র্যাকটিশনার কিংবা ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু করে দিতে পারেন না। তারা হয়তো কোন প্রশিক্ষিত ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের অধীনে এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থী প্র্যাকটিশনার হিসেবে কাজ করতে পারেন, কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে প্র্যাকটিস করার লাইসেন্স পান না। স্বনির্ভর প্র্যাকটিশনারের লাইসেন্স পেতে হলে তাদের ফ্যামিলি মেডিসিন বা জেনারেল প্র্যাকটিসে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি অর্জন করতে হয় (এমডি, রয়্যাল কলেজের ফেলোশিপ ইত্যাদি)। মেডিসিন স্পেশালিস্ট, সার্জন, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রমুখকে যেমন চার বছরের প্রশিক্ষণশেষে ফেলোশিপ বা এমডি পরীক্ষায় পাশ করে বিশেষজ্ঞের স্বীকৃতি লাভ করতে হয়, ফ্যামিলি প্র্যাকটিশনারকেও এমবিবিএস ডিগ্রির পর একই মেয়াদের প্রশিক্ষণশেষে পেশাগত পরীক্ষায় পাশ করে স্বনির্ভর জেনারেল প্র্যাকটিশনার হিসেবে লাইসেন্স পেতে হয়। তাতে ডাক্তার নিজের উপর যেমন আস্থাশীল হন, রোগীরাও পরিপূর্ণ নির্ভরতায় তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন। সে সব দেশে অন্য কোন বিশেষজ্ঞ দেখাতে হলে রোগীকে প্রথমে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানদের দ্বারস্থ হতে হয়। কারণ, ৮০% রোগের চিকিৎসা তাদের দ্বারাই সম্ভব। ফলে অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের উপর রোগী দেখার চাপ কমে। সে কারণে তারা সময় নিয়ে রোগীকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে পারেন। জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের পক্ষে যে সব রোগের চিকিৎসা পূর্ণাঙ্গভাবে দেয়া সম্ভব হয় না সে সব ক্ষেত্রে তারা নির্ধারণ করেন কোন রোগীকে কোন ধরনের বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাবেন। এই সিদ্ধান্তটি রোগী নিজে নেন না। কারণ কোন ধরনের বিশেষজ্ঞ এই রোগের সঠিক চিকিৎসা দিতে পারবেন তা রোগী নন, ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানই ভালো জানবেন।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। ধরে নেই, এক রোগীর বুকে ব্যথা হচ্ছে। প্রথমেই তিনি হয়তো হৃদরোগ মনে করে একজন হৃদরোগবিশেষজ্ঞের কাছে যেতে চাইবেন। হৃদরোগবিশেষজ্ঞ সময় ব্যয় করে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেরে জানালেন এটা হৃদরোগ নয়। এতে অবাক হবার কিছু নেই। বুকের ব্যথার নানা কারণ থাকে। বিভিন্ন রকমের হৃদরোগ ছাড়াও, ফুসফুসের বিভিন্ন ইনফেকশন, পাঁজরের তরুণাস্থির প্রদাহ, পাকস্থলী কিংবা খাদ্যনালীর প্রদাহ, এমনকি মানসিক কারণেও বুকে ব্যথা অনুভূত হতে পারে, যা একজন সাধারণ রোগীর পক্ষে আলাদা করে বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু রোগী ততক্ষণে হৃদরোগবিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে শ্রম, অর্থ এবং সময় ব্যয় করেছেন। এখানেই একজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের ভূমিকা ও সামগ্রিক সমন্বয়ের দায়িত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠে। একজন রোগী প্রথমে তার কাছে গেলে তিনি রোগের ইতিহাস নিয়ে, প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা করে বুঝতে পারবেন এটা এমন কোন রোগ কিনা, যা তিনি সমাধান দিতে পারেন। যদি না পারেন তাহলে তিনি নির্ধারণ করবেন, রোগীকে কোন ধরনের বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে হবে। তাতে ৮০% রোগীর চিকিৎসা প্রাথমিক পর্যায়ে হয়ে যাবে। বাকি ২০% সঠিক বিশেষজ্ঞ দেখাতে পারবেন। এক বিশেষজ্ঞ থেকে অন্য বিশেষজ্ঞের কাছে দৌড়াতে হবে না। বিশেষজ্ঞ সেবার উপরও চাপ কমে আসবে। বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসাসেবা নেবার পর ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান রোগীর চলমান চিকিৎসার ধারাবাহিকতা রক্ষা ও অন্যান্য স্বাস্থ্য বিষয়ক নজরদারি করবেন। এই সমন্বয় ও সামগ্রিক দায়িত্ব পালনের জন্যই একজন জেনারেল প্র্যাকটিশনার হয়ে উঠেন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট