চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

লকডাউনেও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সচল থাকবে যেভাবে

অনলাইন ডেস্ক

২১ এপ্রিল, ২০২০ | ১১:০২ পূর্বাহ্ণ

করোনাভাইরাসের মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও মানুষকে ঘরে রাখতে ও নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে কলকারখানা, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। অঘোষিত লকডাউনের ক্ষতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অর্থনীতির সব সেক্টরে। এই ক্ষতি কমানোর জন্য বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের পরামর্শ আসছে। অনেকে লকডাউন খুলে দিয়ে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন কলকারখানা খোলা রাখার পক্ষে মত দিচ্ছেন। আবার অনেকে লকডাউন অব্যাহত রেখে আগে মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদ দিচ্ছেন।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই লকডাউনের মধ্যেও দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে সরকারকে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তবে সবকিছুর আগে খাদ্য উৎপাদন তথা কৃষি খাতের প্রতি সরকারের মনোযোগ বাড়ানো জরুরি বলে মত দিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, তাদের পরামর্শ কাজে লাগালে একদিকে করোনাভাইরাসের মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে, অন্যদিকে অর্থনীতির চাকাও সচল থাকবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, লকডাউনের মধ্যেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব। এক্ষেত্রে কয়েকটি কাজ করতে হবে। তা হলো— মানুষ যাতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারে, তার বন্দোবস্ত করতে হবে। অর্থাৎ লকডাউনের মধ্যে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যাতে থাকে, সেই উদ্যোগও নিতে হবে। কারণ, খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না পাওয়া গেলে জনঅসন্তোষ দেখা দিতে পারে। এজন্য এখন গ্রাম থেকে শহরে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজটি চালু রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা থাকতে হবে দুটি বিষয়ে। এক. গ্রাম থেকে উৎপাদিত পণ্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় শহরে পৌঁছে দেবে সরকার। দুই. গ্রাম আর শহরের দাম যাতে একই থাকে। অর্থাৎ প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক যে পণ্য ১০০ টাকায় বিক্রি করবে, সেই পণ্য ঢাকা শহরের ক্রেতা যেন ১০০ টাকাতেই কিনতে পারে। একইভাবে মাছ, মাংস, ফল-ফলাদি গ্রাম থেকে শহরে পৌঁছানোর দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে, যাতে শহরের মানুষকে ১০০ টাকার জিনিস ৩০০ টাকা দিয়ে কিনতে না হয়।

তিনি বলেন, ‘কৃষকের পণ্য গ্রাম থেকে শহরে আনার ক্ষেত্রে কোনও কড়াকড়ি করা যাবে না। কৃষকের পণ্য দেশের সব হাট-বাজারে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আবার মানুষ যাতে, হাট-বাজার থেকে সুরক্ষার মধ্যেও ন্যায্য মূল্যে পণ্য কিনতে পারে, সে ব্যবস্থাও রাখতে হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলেও জনঅসন্তোষ দেখা দিতে পারে। এ জন্য কোনও পণ্য পচানো যাবে না। প্রয়োজনে সরকার কিনে নেবে। তারপর, ন্যায্য মূল্যে জনগণের কাছে সরকার সেই পণ্য বিক্রি করবে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কোনও পণ্য যাতে না পচে, সে জন্য সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, একদিকে যখন পচবে, তখন অন্যদিকে সংকট দেখা দেবে।’ তিনি বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যেও পণ্যের ট্রাক আগের মতোই সচল করে দিতে হবে। প্রয়োজনে ট্রাকচালক বা হেল্পারকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে রাস্তায় নামাতে হবে। সবার মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস, ড্রাইভার ও হেল্পার নিরাপদ দূরত্বে থাকবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে পারলে অর্থনীতির চাকাও সচল থাকবে। অর্থনীতি সচল রাখতে হলে লম্বা সময়ের জন্য দোকানগুলো খুলে দিতে হবে।’ সন্ধ্যা ৫টা বা ৬টার সময় দোকান বন্ধ করার নিয়ম তুলে দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সময় বেঁধে দেওয়ার কারণে ভিড় আরও বেশি হচ্ছে। সুপার শপের মালিকরা যদি সারা রাত খোলা রাখতে পারে, তাহলে ক্ষতি কী? ভিড় এড়ানোর জন্য মানুষ যাতে তার সুবিধা মতো সময়ে প্রয়োজন হলে রাত ১২টার সময় গিয়েও দোকান থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষকে নিরিবিলি বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পণ্য কেনার সুযোগ করে দিতে হবে।’ সব ধরনের দোকানপাট খোলা রাখার ক্ষেত্রে কোনও সময় বেঁধে দেওয়া উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মানুষকে সবকিছু কেনাকাটা করার সুযোগ করে দিতে হবে। তবেই অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। দোকানপাট চালু থাকলে সেখানে শ্রমিক কাজে থাকবে। ওই দোকানে পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য কিছু শ্রমিক কাজে থাকবে। ওই পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে শ্রমিক। এভাবে শ্রমিকরা কোনও না কোনোভাবে কাজে থাকবে। অর্থনীতিও সচল থাকবে। ক্রেতা না থাকলে দোকান বন্ধ করবে দোকানদার। সরকার বন্ধ করবে কেন?’ তিনি জানান, আমেরিকায় এ পর্যন্ত কোনও দোকান বন্ধের সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। সেখানকার মানুষের যখন দরকার হচ্ছে দোকানে গিয়ে পণ্য কিনছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানও মনে করেন, লকডাউনের মধ্যেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে সরকারকে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। এরমধ্যে সরবরাহ ব্যবস্থা বা সাপ্লাই চেইন চালু রাখতে হবে। যেসব শ্রমিক কাজের জন্য দেশের বাইরে যেতে চান, তাদের যেতে দিতে হবে। তাদের লকডাউনে ফেলা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, ‘যেসব পণ্য গ্রামে উৎপাদিত হচ্ছে কিন্তু বিক্রি করা যাচ্ছে না, সেসব পণ্য স্থানীয় প্রশাসন সঠিক দামে কিনে নেবে। কৃষকের কাছ থেকে কিনে নেওয়া এসব পণ্য ত্রাণের চালের সঙ্গে বা রিলিফের সঙ্গে অসহায় ও গরিবদের দিতে হবে। তাতে, গরিব মানুষ নিত্যপণ্য পেলো, আবার কৃষকও তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পেলো।’ ড. আতিউর বলেন, ‘ঢাকা শহরের ছোট ছোট দোকানগুলোতে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য যাতে পৌঁছানো যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। মাঠে বা রাস্তার পাশে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে কাঁচাবাজার গড়ে তুলতে হবে।’

আতিউর রহমান উল্লেখ করেন, কৃষি উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য সামনে ধান কাটার সময় গ্রামের তরুণ ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে দল গঠন করে কাজে লাগাতে হবে। ধান কাটার মেশিন সরকার কৃষকদের সরবরাহ করবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরও গ্রামে গ্রামে ধান কাটার মেশিন সরবরাহ করতে পারে। এছাড়া, দাওয়াত দিয়ে খাওয়া দাওয়ার মধ্য দিয়ে ধান কাটার কাজ শেষ করতে হবে। এগুলোর আয়োজন করবে স্থানীয় সরকার।

এদিকে, বিভিন্ন দেশ করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেই লকডাউন শিথিল করে তাদের অর্থনীতি সচল রাখতে উদ্যোগ নিচ্ছে। আবার অনেক দেশ তাদের ২০ বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সীদের ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়ে বাকি নাগরিকদের কাজে বের হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশেও এমনটি করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন অনেকে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি সাপ্লাই চেইন সচল রাখা সম্ভব হলে অর্থনীতির যেটুকু ক্ষতি হবে, তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে দেশে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি এড়ানোই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ, হাতেগোনা কিছু শিল্পকারখানা ছাড়া বেশিরভাগেরই চাকা ঘুরছে না। এতে কর্মহীন হয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন গৃহবন্দি অবস্থায়।’ তিনি বলেন, ‘লকডাউনের কারণে পরিবহন সংকট চারদিকে। এতে পণ্য পরিবহন করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটার সময় এসেছে। সাধারণত অন্য জেলা থেকে কৃষি শ্রমিকেরা বোরো ধান কাটতে আসেন। কিন্তু করোনার কারণে চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ থাকায় তারা আসবেন কীভাবে? সময় মতো এই কৃষি শ্রমিকেরা ক্ষেতে-খামারে থাকতে পারবেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সে বিষয়টি সরকারের দেখা উচিত।’

প্রসঙ্গত, অর্থনীতি সচল রাখতে সরকার ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এই প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতি সচল করতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

এদিকে অর্থনীতি সচল রাখতে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি সরকারের কাছে ৬টি প্রস্তাব দিয়েছেন। গত শুক্রবার (১৭ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, অর্থনীতি সচল রাখতে হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও এনবিআরের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত ফলদায়ক হবে। এছাড়া আমদানি-রফতানি কার্যক্রম অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে প্রধান আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় খোলা রাখতে হবে। যাতে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকরা প্রয়োজনীয় সরকারি অনুমতিপত্র সংগ্রহ এবং কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে পারেন।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ইস্টার্ন রিফাইনারি, এলপি গ্যাস লিমিটেড ইত্যাদি চালু রাখার মাধ্যমে দেশে জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন মাহবুবুল আলম। তিনি বলেছেন, এতে গ্যাস, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা সচল রাখা সম্ভব হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনে রেজিস্ট্রেশন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নবায়নের জন্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) খোলা রাখারও প্রস্তাব করেন তিনি।

এছাড়া সেবাদানকারী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত ছাড়পত্র আবশ্যক, যা যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে নবায়ন করতে হয়। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত ছাড়পত্র নবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দফতর সীমিত আকারে খোলা রাখা উচিত বলেও মনে করে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট