চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

ফাঁসি কার্যকরে আনুষ্ঠানিকতা শুরু

বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদ গ্রেপ্তার

২৩ বছর ছিলেন কলকাতায়

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা অফিস

৮ এপ্রিল, ২০২০ | ৩:০০ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি প্রাণদ-ের সাজাপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (বহিষ্কৃত) আবদুল মাজেদকে অবশেষে ঢাকা থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রায় ৪০ বছর এই খুনি নিরুদ্দেশ ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
মাজেদ ভারতে পালিয়ে ছিলেন বলে বিভিন্ন সময় ঢাকার মিডিয়ায় খবর হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তাকে বাংলাদেশেই পেয়েছি। হয়তো করোনাভাইরাসের ভয়ে চলে এসেছে।
এদিকে, বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুল মাজেদ ২৩ বছর ধরে কলকাতায় অবস্থান করছিলেন বলে নিজেই জানালেন। তাঁর কথায়- তিনি গত ১৬ মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন । ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সরকারি কৌঁসুলি হেমায়েত উদ্দিন খান বলেন, মাজেদ নিজেই এ সব তথ্য জানিয়েছেন তাকে।
বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদকে গত সোমবার দিবাগত রাত পৌনে ৪ টা নাগাদ ঢাকার গাবতলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপপরিদর্শক (এসআই) আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে তিনি দায়িত্বে ছিলেন। সোমবার গভীররাত ৩টা ৪৫ মিনিটে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে সন্দেহজনকভাবে রিকশায় করে যাওয়ার সময় ওই ব্যক্তিকে দাঁড় করান তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অসংলগ্ন কথা বলতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি নিজের নাম ও ঠিকানা প্রকাশ করেন এবং জেরার মুখে তিনি স্বীকার করেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পলাতক আসামি তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে মাজেদ আরও স্বীকার করেন, গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে ছিলেন।’
পরে, গতকাল দুপুরে খুনি মাজেদকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং হেলমেট পরিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪ ধারায় তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। এসময় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার না দেখানো পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন কাউন্টার টেরোরিজমের কর্মকর্তা। আবদুল মাজেদ যখন আসামির কাঠগড়ায় অবস্থান করছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলেন সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হেমায়েত উদ্দিন খান। পুলিশের বক্তব্য শুনে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। শুনানির সময় খুনি মাজেদের পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
পিপি হেমায়েত উদ্দিন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এতদিন কোথায় ছিলেন? জবাবে খুনি মাজেদ জানান, ২২-২৩ বছর তিনি কলকাতায় অবস্থান করেন। সেখান থেকে চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। এরপর তিনি ঢাকায় অবস্থান করছিলেন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, বঙ্গবন্ধুর এই খুনি ৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের জেলহত্যার সাথেও জড়িত। জেলে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ চার সহযোগীকে ওইদিন কারাভ্যন্তরে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মুজিববর্ষের অন্যতম সেরা উপহার হচ্ছে খুনি মাজেদকে গ্রেপ্তার করা। এখন আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁর দ-াদেশ কার্যকর করা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন দ-প্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে দ-াদেশ কার্যকর করার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। তাদেরই একজন ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ আমাদের পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তার স্ত্রী সালেহা বেগম। বাড়ি নম্বর ১০/এ, রোড নম্বর ১, ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকা। তিনি সেখানে বসবাস করতেন। আমাদের গোয়েন্দাদের কাছে তার সব তথ্য ছিল।’
জানা গেছে, খুনি মাজেদ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে আরও কয়েকজন খুনির সঙ্গে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়া চলে গিয়েছিলেন। এরপর তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান তাঁকে সেনেগালের দূতাবাসে বদলি করেন। ১৯৮০ সালে দেশে ফিরে আসার পর মাজেদকে বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি দেন জিয়া। সে সময় উপসচিব পদমর্যাদায় তিনি চাকরি করেন। পরে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে তিনি সচিব পদে পদোন্নতি নেন এবং যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে পরিচালক পদে যোগদান করেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার শুরু করে। সে সময় আত্মগোপনে চলে যান মাজেদ। তাঁর স্ত্রী ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকায় বসবাস করছেন। মাজেদের চার কন্যা ও এক ছেলে রয়েছে। ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করা হয় । কিন্তু এই হত্যাকা-ের বিচারে পদে পদে বাধা আসে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন।
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদ-াদেশ দিয়ে রায় দেন। নি¤œ আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদ- নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন। কিন্তু এরপর ছয় বছর আপিল শুনানি না হওয়ায় আটকে যায় বিচারপ্রক্রিয়া।
দীর্ঘ ছয় বছর পর বিগত তদারকি সরকারের আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আবার গতি পায়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পাঁচ আসামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। আপিলের অনুমতির প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুনানি শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনির মৃত্যুদ-াদেশ বহাল থাকে। এর মধ্য দিয়ে ১৩ বছর ধরে চলা এই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হয়।
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। ওই রায় কার্যকরের আগেই ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান আসামি আজিজ পাশা।
কে এই ক্যাপ্টেন মাজেদ ?
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ফাঁসির দ-প্রাপ্ত পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদকে গতকাল ভোরে গ্রেপ্তারের পর আদালতে হাজির করা হলে তাকে দেখতেই আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় জমে।
সবার প্রশ্ন কে এই মাজেদ?
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারা গ্রামের মরহুম আলী মিয়া চৌধুরীর ছেলে ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ। ১৯৭৫ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকা-ের সময় তিনি অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। হত্যাকা- শেষে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার অপর আসামি মেজর শাহরিয়ারসহ অন্যান্য সেনা সদস্যদের সঙ্গে রেডিও স্টেশনে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ক্যূতে অংশ নেওয়া অফিসারদের সঙ্গে বঙ্গভবনে দেশ ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হত্যাকা-ে অংশগ্রহণকারী অফিসারদের সঙ্গে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের আদেশে বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়া গমন করেন। তিনি সেখানে অফিসারদের সঙ্গে তিন মাস অবস্থান করেন। অবস্থানকালীন সময়ে হত্যাকা-ের পুরস্কার হিসেবে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান তাকে সেনেগাল দূতাবাসে বদলির আদেশ দেন।
পরবর্তীতে ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান সরকার ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি দেন এবং উপসচিব পদে যোগদানের সুবিধার্থে সেনাবাহিনী চাকরি থেকে তিনি অবসর নেন। পরবর্তীতে তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর তিনি মিনিস্ট্রি অফ ইয়ুথ ডেভেলপমেন্টে ডাইরেক্টর ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট পদের জন্য আবেদন করেন এবং উক্ত পদে যোগদান করেন। সেখান থেকে তিনি ডাইরেক্টর অফ হেড অফ ন্যাশনাল সেভিংস ডিপার্টমেন্টে বদলি হন।
ফাঁসি কার্যকরে আনুষ্ঠানিকতা শুরু : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের ফাঁসির দ- কার্যকরে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল মঙ্গলবার এক ভিডিও বার্তায় তিনি এ কথা জানান। গত সোমবার গভীররাতে ঢাকার গাবতলী থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করে।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি (ক্যাপ্টেন মাজেদ) বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্র ও হত্যাকা-ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ক্যাপ্টেন আবদুল মজিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়ার পর বিচারিক আদালত এবং আপিল বিভাগ তাকে ফাঁসির দ-ে দ-ায়িত করেন। এখন ক্যাপ্টেন আবুল মাজেদের বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করার জন্য আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই এ রায় কার্যকর করা হবে।’
আনিসুল হক বলেন, ‘আমার কাছে প্রশ্ন এসেছে- আবদুল মাজেদ কারাগারে, তিনি সেখানে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারেন কি না? আবদুল মাজেদ ফাঁসির দ-ে দ-ায়িত একজন আসামি। ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামিদের কারাগারে সলিটারি কনফাইন্ডমেন্টে রাখা হয়। আবদুল মাজেদ যেহেতু সলিটারি কনফাইন্ডমেন্টে থাকবেন, সেহেতু তিনি করোনাভাইরাসের কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি করবেন না।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট