আট বছর আগে ৫ম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যায় রাব্বির জীবনে। সে যাত্রায় দীর্ঘ চিকিৎসায় প্রাণে বাঁচলেও চিরদিনের জন্য হারাতে হয় দুটি হাত। সেই থেকে তার ভবিষ্যৎ ধাবিত হয় অনিশ্চিয়তার দিকে। মা-বাবাসহ শুভাকাক্সক্ষীরা ধরেই নিয়েছিলেন আর পড়াশোনা করা হবে না তার।
কিন্তু অদম্য মনোবল যার, তাকে রুখবার সাধ্য কার? রোখা যায়নি রাব্বিকেও। হাত না থাকলেও মুখ এবং পা দিয়ে লেখা আয়ত্ত করে পুনরায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকে সে। মুখ দিয়ে লিখে জেএসসি পরীক্ষায় সাফল্য পায় সে। চলতি বছর পা দিয়ে লিখে দেয় এসএসসি পরীক্ষা। গতকাল রবিবার ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা যায়, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে এই অদম্য মেধাবী।
প্রতিকূলতার কাছে হার না মানা এ তরুণের পুরো নাম রফিকুল ইসলাম রাব্বি (১৬)। সে সীতাকু-ের ভাটিয়ারী এলাকার দরিদ্র দিনমজুর বজলুর রহমানের ছেলে। রাব্বির এ সাফল্যে উচ্ছ্বসিত তার বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মা-বাবা, শিক্ষা কর্মকর্তাসহ প্রতিবেশীরাও। এ সফলতায় ভালো লাগার কথা জানায় রাব্বিও।
জানা যায়, সমাজের আর পাঁচজনের মতোই সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ ছিল রাব্বি। ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর তার জীবনে ঘটে যায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। সেদিন রাব্বি বিদ্যালয় থেকে ভাটিয়ারী বাজারের একটি ফুটওভারব্রিজের উপর দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ব্রিজের উপরে পড়ে থাকা একটি বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে যায় সে। এতে তার দুই হাতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে দীর্ঘ কয়েক মাসের চিকিৎসায় সুস্থ হলেও কেটে ফেলতে হয় দুটি হাত। এ ঘটনার পর সবাই ভেবেছিলেন রাব্বির আর পড়াশোনা হবে না।
কিন্তু রাব্বি অদম্য। সে হার মানতে রাজি নয়। স্বপ্নকে সত্য করতে সে মুখ দিয়ে লেখার পদ্ধতি চর্চা করতে শুরু করে। একপর্যায়ে মুখ দিয়ে ভালোভাবে লিখতে শিখে একের পর এক পরীক্ষায় সাফল্য পেতে থাকে। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত মুখ দিয়ে লিখে সাফল্য পেলেও আরও দ্রুতগতিতে লিখতে পা দিয়ে লেখা আয়ত্ত করে রাব্বি। পা দিয়ে সাবলীলভাবে লিখতে শেখার পর এবার স্থানীয় ভাটিয়ারী হাজী টিএসসি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পা দিয়ে লিখেই এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে সফলতা পায় সে।
রাব্বি জানায়, মৃত্যু থেকে বেঁচে আসার পর মা-বাবা, শিক্ষকসহ আরও কিছু মানুষ তাকে প্রেরণা দিয়ে এগিয়ে নেন। স্থানীয় সাংবাদিকরাও শুরু থেকে তাকে নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন লেখায় অনেকেই এগিয়ে আসেন সহযোগিতায়। রাব্বির স্বপ্ন একদিন সে বিজ্ঞানী হবে। এজন্য সকলের দোয়া চায়।
ছেলের সাফল্যে ভীষণ খুশি বজলুর রহমান। তিনি বলেন, যেদিন দুর্ঘটনাটি ঘটে সেদিন রাব্বিকে বাঁচাতে পারবো কিনা তাও বুঝতে পারিনি। দীর্ঘ চিকিৎসায় বাঁচলেও দুটি হাত হারিয়ে যাওয়ায় তার পড়াশোনার কথা তো চিন্তাও করিনি। কিন্তু আমার ছেলে স্কুলে যাবেই। অন্যদের স্কুলে যেতে দেখলে সে মন খারাপ করে থাকতো। পরে মুখ দিয়ে লিখে পড়াশোনা শুরু করে। এখন পা ও মুখ দিয়ে সমানভাবে লিখতে পারে। সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন যেন অনেক দূর যেতে পারে।
রাব্বির বিদ্যালয় ভাটিয়ারী তোবারক আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য্য বলেন, রাব্বির চেষ্টা ছিল। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও সে নিজেকে কখনও প্রতিবন্ধী মনে করেনি। বরং অন্যরা যা পারে সেও তাই পারবে- এমনটাই ছিল তার বিশ্বাস। আজ সে বিশ্বাসেই তার এই সফলতা। সে জিপিএ-৫ পাওয়ায় আমরাও গর্ববোধ করছি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তফা আলম সরকার বলেন, রাব্বির এই সফলতায় আমরা অত্যন্ত খুশি। সে সমাজের অন্য সবার জন্য প্রেরণা। তাকে দেখে অন্য ছাত্রদেরও মনোবল বাড়বে। দুটি হাত ছাড়াই যদি সে এমন ফলাফল করে তাহলে অন্যরা তো পিছিয়ে থাকার কথা নয়। এটুকু বুঝলে সবাই রাব্বির মতোই সফলতা পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
পূর্বকোণ/পিআর