সীতাকুণ্ডে বেড়াতে এসে সাগরে নেমে একের পর এক পর্যটকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। গত দুই সপ্তাহে এখানে দুটি সমুদ্র সৈকতে ডুবে মারা গেছেন তিন পর্যটক। একইভাবে গত ৫ বছরে এখানে ডুবে মারা গেছেন ৭ জন দর্শনার্থী। নিজেদের অসতর্কতায় ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে সাগরে নেমে এভাবে তরতাজা প্রাণগুলো হারিয়ে গেলেও পর্যটকরা সচেতন হচ্ছেন না। ফলে দুর্ঘটনায় প্রানহানি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকৃতির লীলাভূমিখ্যাত সীতাকু-ের পশ্চিম অংশে রয়েছে সুবিশাল বঙ্গোপসাগর। এই সাগরের পাড়ে প্রকৃতিগতভাবেই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু পর্যটন স্পট। সাগর উপকূলের বালু চর, সবুজ বৃক্ষরাজি, ঝাউবনসহ প্রকৃতির নানান সৃষ্টি এ স্থানগুলোকে অপরুপ করে তুলেছে। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে ছুটে আসেন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের দল।
এদিকে প্রাকৃতিকভাবে উপজেলার গুলিয়াখালী, কুমিরা, বাঁশবাড়িয়াসহ নানান স্থানে সুবিশাল সমুদ্র সৈকত গড়ে উঠলেও গুলিয়াখালী ছাড়া আর কোন স্পটই সরকারিভাবে স্বীকৃত না হওয়ায় এসব স্থানে কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া এখানকার সাগর পাড়ে বালির চেয়ে কাদা মাটি বেশি হওয়ায় সাগরে নেমে গোছলের পরিবেশ নেই। শুধুমাত্র উপকূলে বসে সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যেতে পারে। কিন্তু দূরাগত পর্যটকরা এসব পরিবেশের কথা বিবেচনা না করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে সাগরে নেমে পড়ছেন। ফলে তারা দুর্ঘটনা কবলিত হচ্ছেন। এভাবে এখানে বেড়াতে এসে গত সোমবার বিকালে বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসেন একদল বিশ্ব বিদ্যালয় ছাত্র। সন্ধ্যার দিকে তাদের মধ্যে তিন জন সাগরে নেমে গোসল করার সময় ভাটার টানে দুই ছাত্র মো. আলী হাসান মারুফ (২৩) ও এনায়েত উল্ল্যাহ চৌধুরী (২২) ভেসে যান। পরে রাত ১০টার পর তাদের লাশ উদ্ধার হয়।
সে দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা দেন সমুদ্র সৈকত থেকে বেঁচে ফেরা শিক্ষার্থী একরাম হোসেন। তিনি জানান, সন্ধ্যায় তারা তিন বন্ধু মিলে সৈকতে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজের শেষ প্রান্তে চলে যান। সমুদ্রের কোমর সমান পানিতে গিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেও মারুফ ও এনায়েত সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। একপর্যায়ে দু’জনে গলা সমান পানিতে চলে যান। এসময় তিনি বিপদের আশঙ্কা রয়েছে মনে করে তাদের ফিরে আসতে বলেন। কিন্তু তারা তা উপেক্ষা করেন, উল্টো ভয় পেলে তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই ভাটার টানে হারিয়ে যান তারা। আকস্মিক এই ঘটনায় তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। সৈকতের পাড়ে উঠে কান্না জড়িত কন্ঠে আকরাম হোসেন বলেন, বন্ধুরা যদি তার কথা উপেক্ষা না করতো, তাহলে অকাল এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো না।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন এর আগে গত ৪ জুলাই গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে গোসল করতে নেমে মারা যায় মেহেদী হাসান (১৬) নামক আরো এক ছাত্র। মাত্র ২০ দিনের মধ্যে দুটি সমুদ্র সৈকতে তিনজনের মৃত্যুই শুধু নয়, এর আগে ২০১৮ সালে বাঁশবাড়িয়ায় সমুদ্র সৈকতে গোসলে নেমে সাইফুল, আলাউদ্দিন ও ইয়াসিন নামক ৩ পর্যটকের প্রানহানির ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে গোসলে নেমে প্রাণ হারান আরেক বিশ্ব বিদ্যালয় ছাত্র।
বাঁশবাড়িয়ার ইউপি চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী জাহাঙ্গীর জানান, আসলে এখানে সাগর উপকূলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার মতো। কিন্তু সবসময় সাগরে নামার মতো পরিবেশ থাকে না। ভাটার সময় তো সাগরে নামা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সোমবার ছাত্ররা কোন নিয়ম না মেনে সাগরে নামায় ভেসে যান। একটু সতর্ক থাকলে এমনটা হতো না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, সীতাকু-ের এ দুটি সমুদ্র সৈকতে প্রতিনিয়ত দূর-দূরান্তের হাজার হাজার পর্যটক ও দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন। কিন্তু তাদের অসতর্কতার কারণে সৈকতে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ বিষাদে পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন, সৈকতে আগত পর্যটকদের সর্তকতা অবলম্বনে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা সম্বলিত সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু অতি উৎসাহী পর্যটকরা সেগুলোকে উপেক্ষা করে গোসল করতে সাগরে নামছে। পর্যটকরা সাগরে সতর্কতার সঙ্গে বা নিয়ম মেনে গোসলে নামলে সহজেই এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
ইউএনও শাহাদাত হোসেন আরো বলেন, সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া দু’পর্যটক নিহতের ঘটনার পর সমুদ্র সৈকতে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলেছেন। তিনি অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এ দুটি সমুদ্র সৈকতে প্রচারণা আরও জোরদার করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
পূর্বকোণ/পিআর