ধানের মৌসুমে হাতির পাল লোকালয়ে ছুটে আসে, সাবাড় করে দেয় ধান ক্ষেত। এবার পাহাড়ে আম খেতে এসে ধ্বংস করে দিল আম বাগান। বোয়ালখালীর পাহাড়ি অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে অন্তত ৭টি আম বাগান লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে হাতির পাল।
বাগান মালিকেরা জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে হাতির পাল পাহাড়ি অঞ্চলে আম বাগানে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। আম খেয়ে শত শত আম গাছ উপড়ে ফেলেছে। আম বাগান ছাড়াও লিচু বাগানেও আক্রমণ চালিয়েছে হাতির পাল।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক মোজাম্মেল হক বকুল বলেন, ‘আমার একটি বাগানে তাণ্ডব চালিয়ে দেড় শতাধিক আম গাছ ধ্বংস করে দিয়েছে হাতির পাল। আমসহ সবকটি গাছ উপড়ে ফেলেছে। গাছগুলো এখন লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।’
কৃষকেরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বন্য হাতির পাল পাহাড়ি অঞ্চলে তাণ্ডব চালিয়ে আসছে। পাহাড়ে ফলমূলের বাগান প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কৃষকেরা এখন লেবু বাগানের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। কাঁটা থাকায় লেবু বাগানের দিকে যায় না হাতির পাল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্থানীয় বাগানিরা লেবু বাগানের ভেতরে ভেতরে আম, লিচু, পেঁপেসহ নানা ধরনের ফলমূলের চাষাবাদ করে আসছেন। অন্তত পাঁচ বছর ধরে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে উঠেছে অনেক আম বাগান। এছাড়াও পাহাড়ের কোলে অনেকেই মাছের খামার গড়ে তুলেছেন।
মোছলেম উদ্দিন নামে এক বাগানি জানান, তিনটি বাগানে আক্রমণ চালিয়ে অন্তত ১৩০টি গাছ ধ্বংস করে দিয়েছে। বাণিজ্যিক নয়, শখের বশে এ বাগান করেছিলাম। শখের বাগান এখন গুঁড়িয়ে দিল হাতির পাল।
প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় কৃষক মোজাম্মেল হক বলেন, ১০-১৫ বছর আগে বোয়ালখালীকে পেয়ারার রাজ্য বলা হতো। হাতির তাণ্ডবে পেয়ারা বাগান ধ্বংস হয়ে গেছে। কৃষকেরা বাঁক বদল করে লেবু বাগানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু ৪-৫ বছর ধরে বন্য হাতির তাণ্ডব খুবই বেড়ে গেছে। আমন ও বোরো মৌসুমে লোকালয়ে ছুটে আসে। ধান ক্ষেত সাবাড় করে বাড়িঘরে পর্যন্ত আক্রমণ চালায়।
বোয়ালখালীর জৈষ্ঠ্যপুরা থেকে কড়লডেঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাহাড় ও লোকালয়ে তা-ব চালায় হাতির পাল। খাবারের খোঁজে হাতিগুলো লোকালয়ে আসে বলে জানান বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয়রাও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
বন্যপ্রাণী নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, হাতির আবাসস্থল ও খাদ্য কমে যাওয়া, চলাচলের পথ (করিডোর) বাধাগ্রস্ত, সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া ও ফাঁদ পেতে হাতি হত্যাসহ নয় কারণে লোকালয়ে নেমে আসছে বন্য হাতির পাল। ২০০৪ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, হাতির চলাচলের পথে অধিক মানুষের বসবাস, সড়ক ও নানা স্থাপনা নির্মাণের কারণে হাতি লোকালয়ে নেমে আসে।
বন্যপ্রাণী গবেষকদের সূত্র ধরে দেখা যায়, বোয়ালখালীর জৈষ্ঠ্যপুরা থেকে রাঙ্গুনিয়ার কোদলা এলাকা পর্যন্ত ঘন বন ও পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। ওই পথে হাতির চলাচল বা বিচরণক্ষেত্র ছিল বলে জানান এলাকাবাসী। হাতির চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত ও পাহাড় কেটে ফেলায় হাতির খাবার সংকট সৃষ্টি হয়। এসব কারণে ধানের মৌসুমে লোকালয়ে নেমে আসে হাতির পাল। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার গবেষণার সাযুজ্য পাওয়া যায়।
২০০৬ সালে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বাংলাদেশের হাতি নিয়ে গবেষণা করে। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে দু-আড়াই শ স্থায়ী হাতি রয়েছে। ৮০-১০০টি অস্থায়ী বা ভ্রমণকারী হাতি রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শত বছর আগে বাংলাদেশের মধুপুর থেকে শুরু করে গারো পাহাড়, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ঘেরা সবুজ অঞ্চলে হাতির বিচরণক্ষেত্র ছিল। পাহাড়ে হাতির খাবার উপযোগী উদ্ভিদের অভাব ছিল না। তাই পাহাড়ি অঞ্চলে নিরাপদে বিচরণ করত।
‘হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম ও সঠিক পদ্ধতি শনাক্তকরণ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বন বিভাগ, আইইউসিএন, এসআরসিডব্লিউপি। লোহাগাড়া, বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া, খুরুশিয়া, দোহাজারী রেঞ্চ, বান্দরবান সদর এলাকায় হাতির গতিবিধি নিয়ে এ গবেষণা করা হয়। তাতে বলা হয়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত চুনতি, রাঙ্গুনিয়া ও বান্দরবানে ৯৪৯ বার শস্যক্ষেত্রে আক্রমণ চালিয়েছে হাতির পাল। ১২৪টি বসতি ও ১৭টি বাণিজ্যিক বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাতির আক্রমণে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মানুষের আক্রমণে ৩টি হাতি মারা গিয়েছিল।
বোয়ালখালী, পার্বত্য বান্দরবান ও রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি অঞ্চল একই সীমা রেখায় অবস্থিত বিধায় ভৌগোলিক দিক থেকে বোয়ালখালীর পাহাড়ি অঞ্চল হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড় কেটে সড়ক ও নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণে জনবসতি বেড়ে যাওয়ায় হাতির বিচরণক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যায়। এতে হাতির পাল লোকালয়ে নেমে আসে। সাবাড় করে দিচ্ছে ধান ও ফলমূলের বাগান।
পূর্বকোণ/পিআর