চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

ওম্যান্স ক্রিকেট একাডেমি: ‘কেন’র জবাব দিতেই ক্রিকেট খেলছি’

হুমায়ুন কবির কিরণ

৩১ জানুয়ারি, ২০২১ | ১১:১৮ পূর্বাহ্ণ

ঘর থেকে বের হলেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। ‘তুমি মেয়ে হয়ে কেন ক্রিকেট খেলবে’-এই কেন’র জবাব দিতেই আমি ক্রিকেট খেলছি। একদিন জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের নাম লিখিয়ে সব প্রশ্নের জবাব দেবো। কথাগুলো পিনাকল চাটার্ড স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার জুহির।

চোখেমুখে রাজ্যের স্বপ্ন নিয়ে জুহির সাথে পুজা দে’ও এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে প্রশিক্ষণ মাঠে অনুপযুক্ত পরিবেশে ক্রিকেটে দীক্ষা নিচ্ছে। তারা দু’জনেই জুনিয়র ক্রিকেট একাডেমির প্রশিক্ষনার্থী। তবে নিজেদের একাডেমি নয়, তাদের পাওয়া গেলো চট্টগ্রাম ওম্যান্স ক্রিকেট একাডেমির অন্য মেয়েদের সাথে নিয়মিত অনুশীলনে। জুহি প্রতিদিনই অনুশীলনে যোগ দেন মা’কে সাথে নিয়ে। মা একটি বিউটি পার্লার চালালেও মেয়ের স্বপ্নে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। পার্লার বন্ধ করেই মার্শাল আর্টে দক্ষ মা-মেয়ে বিকালটা কাটান স্টেডিয়ামে।

জুহি জানালেন, শুরুতে অনেক বাধা-বিপত্তি সইতে হয়েছে। এলাকার আশ পাশের মানুষ এমনকি প্রতিবেশীদের অনেকই কটু কথা বললেও জাহানার আলম (টাইগ্রেস ফাস্ট বোলার) হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাঠে ছুটে যাই। নাচ ও নাটকে পারদর্শী জুহি বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলায় (নাটকে) গত বছর ৬৪ জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন। তবে নাচ-গান নয় জুহির স্বপ্ন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানো।

জুহির মা’র সাথে কথা হলে স্বপ্নজড়ানো কন্ঠে বললেন, মেয়ের অনেক স্বপ্ন, বাঁধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে মেয়ে নিয়ে যুদ্ধে নেমেছি। করোনাকালীন সময়ে স্বামীর চাকরী থেকে শুরু করে নিজের পার্লারের ব্যবসাতেও ধ্বস নেমেছে। তাই বলে মেয়েকে ক্রিকেটার বানানোর মিশনে কোন ছাড় নয়।

একই স্বপ্ন দেখেন পুজা দে’ও। পুজা আসেন বালু চড়া থেকে। নবম শ্রেনি পড়ুয়া পুজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফতেহাবাদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বালু চড়া থেকে একাই যোগ দেন একাডেমির অনুশীলনে। জুহি আর পুজা দু’জনেই বিকেএসপির সর্বশেষ ঘোষিত নারী ক্রিকেট ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন। ক্যাম্পে সাফল্য পেলে তাদের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন আরও মজবুত ভিত্তি পাবে।

জুহি আর পুজাদের ক্রিকেটে পথচলা মসৃণ না হলেও নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবতে পারেন নুসরাত ইয়াসমিন জান্নাত। নগরীর বাওয়া স্কুলের দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত জান্নাত শুরু থেকেই বাবা-মা সহ পরিবারের সকলের সমর্থন পেয়েছেন।

আগ্রাবাদে থাকা জান্নাত জানালেন, বাবা-মা সবসময় বলেন, তুমি যা করতে পারো, যা করতে তোমার ভালো লাগে তাই কর। তবে পড়ালেখায় ক্ষতি করে নয়। আমিও তাঁদের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার চেষ্টা করছি। চট্টগ্রাম ওম্যান্স ক্রিকেট একাডেমির অধিনায়িকা জান্নাত জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়িয়ে নিজের, সাথে বাবা মা’র স্বপ্নও পূরনে আত্ববিশ্বাসী।

ক্রিকেট এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। প্রতিদিন বিকালে স্টেডিয়াম পাড়ায় গেলেই মিলবে ক্ষুদে ছেলেদের ক্রিকেট ব্যাটবল নিয়ে দাপদাপি। মেয়েদের সংখ্যা সে তুলনায় একান্তই কম। চট্টগ্রামে হাতে গোনা কয়েকটি একাডেমি মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করছে। তাদের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম ওম্যান্স ক্রিকেট একাডেমি।

প্রায় ৩৮জন কিশোরী নিয়ে নিয়মিত কাজ করা চট্টগ্রাম ওম্যান্স ক্রিকেট একাডেমি ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম মাঠে যাত্রা শুরু করে। সে ধারবাহিকতায় আরও কিছু একাডেমি মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করলেও ব্যাপকতা ও নিয়মিত কার্যকলাপে চট্টগ্রাম ওম্যান্স ক্রিকেট একাডেমিই এগিয়ে।

বলে রাখা ভালো চট্টগ্রামে একাডেমির প্রথম যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। সে সময় চট্টগ্রাম ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন ক্রিকেট কোচ, আম্পায়ার, ক্রীড়া সাংবাদিক এবং ক্রীড়া সংগঠক সিজেকেএস কাউন্সিলর সাইফুল্লাহ চৌধুরী। তার হাতেই গড়া চট্টগ্রাম ওম্যান্স ক্রিকেট একাডেমি। শুরুতে বাওয়া স্কুলের অধ্যক্ষের সহযোগিতায় পাওয়া মেয়েদের নিয়ে ৭-৮ মাস অনুশীলনের পর বাওয়া স্কুলের নামে জাতীয় স্কুল ও মাদরাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ক্রিকেট ইভেন্টে অংশ নেয় মেয়েরা। সেখানে থানা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন এবং জেলা পর্যায়ে রানার্স আপ হয় তারা। পরে বাওয়া স্কুলের সেই মেয়েদের সাথে লালখানবাজার শহীদ নগর স্কুলের ১৫-২০ জন মেয়ে এসে চট্টগ্রাম ওমেন্স ক্রিকেট একাডেমির অনুশীলনে অংশগ্রহন করে। তৃতীয় ধাপে আলকরনের উপলব্দি শিশু সদনের এতিম মেয়েরা একাডেমির অনুশীলনে আসে। এই মেয়েদের একাডেমির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেয়া হয়। এরা এখনও অনুশীলন করছে।

২০১৯ সালে জেলা রানার্স আপ বাওয়া স্কুলের মেয়েরা পরবর্তীতে ২০২০ সালে জেলা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। স্কুলের নামে প্রতিযোগিতায় খেললেও এরা সবাই একাডেমিতে অনুশীলন করে। করোনায় ৮/৯ মাস অনুশীলন ব্যাহত হয়। দু’তিন মাস হচ্ছে আবার মেয়েরা মাঠে আসছে। কিন্তু অনেককে তাদের অভিভাবকরা মাঠে আসতে দিচ্ছেন না করোনার ভয়ে।

এদিকে সিজেকেএস সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং সিজেকেএস ক্রিকেট কমিটির সম্পাদক আবদুল হান্নান আকবর একাডেমির মেয়েদের সুবিধার্থে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের ভেতরে অনুশীলন করার অনুমতি দিয়েছেন। তাঁরা মেয়েদের জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দের ব্যাপারেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

একাডেমির পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাহী সাইফুল্লাহ চৌধুরী এ জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। অনুশীলনের মাধ্যমে উন্নতি করা একাডেমির ২ জন মেয়ে ক্রিকেটার বিকেএসপিতে সুযোগ পেয়েছে। এখন একাডেমিতে ৩০-৩৫ জন মেয়ে আছে। এদের মধ্যে ৪-৫ জনকে জেলা টিমে প্র্যাকটিস করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এদের বিভাগীয় দলের খেলার জন্য তৈরি করা হচ্ছে।

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট