চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

লিলু মাঝির জীবন পার নৌকায়

বিপ্লব বড়–য়া হ রাঙ্গুনিয়া

১৩ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৩৩ পূর্বাহ্ণ

রাঙ্গুনিয়ার কোদালা ঘাট। বহু বছর থেকে এই নামটি শুনছি। এই ঘাট দিয়ে এবারই প্রথম পার হচ্ছি। আগে কোনসময় ওই এলাকায় আমার যাওয়া হয়নি।

সময় তখন ঘড়ির কাটায় সকাল ১১টা। প্রচ- কড়া রোদ। তীব্র কড়া রোদকে কাঠফাটা রোদও বলা হয়। এই রোদের বিষয়ে বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে যারা বাস করে তারাই জানেন। চোখতো খোলাই যাচ্ছে না। যে ক’বার যীশু’দা ক্যামেরা অন করে ক্লিক করছিল কোনবারও চোখের চাহনিটা ভালো হয় না। এককথায় সূর্যের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মাথায় গামছা পেচানো, হাসি হাসি মুখখানিতে মায়া লেগে আছে। কালো রংয়ের মানুষটিকে বেশ যুতসই দেখাচ্ছে। গামছার আওলা-যাওলার কারণে পুরো মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। বললাম গামছাটা মুখ থেকে সরিয়ে নেন, একটা ছবি নেবো। তিনি বললেন, ভাই আমি হইলাম গরিব মানুষ, আমার ছবি নিয়া কি হইবো। এই দু-চারটি কথার মধ্যে লিলু মাঝি আমার মনের মধ্যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিলো। তারপর, নৌকায় চড়তে চড়তে তার সাথে কিছুসময় আলাপ জুড়ে দিলাম। কথা বললাম জীবনের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। কালো রংয়ের এই মানুষটি পুরোটা দিন নৌকা চালিয়ে কাটান।

কড়া রোদের কারণে আজকে আরো বেশি তাকে কালো মনে হচ্ছে। নাম জিজ্ঞাসা করতেই বললেন কি একটা জানি-বোটের ফটফট আওয়াজে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। আমাদের বোটটা তখন নদীর ঠিক মাঝখানে দুলছে। মনের ভেতর একটু একটু ভয়ও করছে, সাথে থাকা যীশু দাকেও কিছু বলছি না। অনেকদিন পরে এ জাতীয় বোট বা নৌকায় উঠেছি। মাঝিকে ভালোবেসে কথা বললে কি হবে, মনের মধ্যে কিন্তু ভয় ভয় আতংক বিরাজ করছে। দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে জুতোর ফিতা খুলে রাখার জন্য হাতটা একবার জুতোয় দিচ্ছি আবার তুলছি। এই ভয়ের কথা প্রকাশও কিন্তু করছি না। আবার মনের ভিতর একটু-আধটু সাহসও আছে, যেহেতু ছোটকালে গ্রামে কাটিয়েছি, সাঁতার জানি বলে। মাঝিকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম নামটা জানি কি বললেন ? এবার বলল, লিলু। পুরোনাম জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, লিলু মাঝি। বললাম, আপনার কি একটাই নাম? এবার বললেন, তপন দাস। তাকে লিলু মাঝি বলে সবাই চিনে। আসল নামটি কাউকে বলা লাগে না। একমাত্র খুঁটিনাটি জানাওয়ালাদের ছাড়া এই নামটি অন্য কাউকে তেমন বলা হয় না। সে বলল, একেবারে ছোটকাল থেকেই তার নৌকার সাথে সম্পর্ক। বয়স যখন তার ৫। সে বয়সে স্কুলে না গিয়ে ধরতে হয়েছে নৌকা চালানোর কাজ। অভাবের সংসারে এ সময় নৌকায় উঠা ছাড়া বিকল্প কিছু করার ছিল না।

বর্তমানে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত একটানা ১২ ঘণ্টা নৌকা চালিয়ে (ইঞ্জিন বোট) দিনে আয় করেন ৬০০ টাকা। এই টাকা দিয়েই টেনেটুনে কোনরকমে সংসার চলে। ১ ছেলে ১ মেয়ের সংসারে স্ত্রীকে নিয়ে তার ছোট্ট বসতি। দুঃখ কষ্টে জীবন চলে লিলুর। এরই মাঝে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, আর ছেলে দিনমজুরের কাজ করে। বললাম, ছেলেকে লেখাপড়া শেখাননি কেন ? উত্তরে বললেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছি, তারপর আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ভিতু ভিতু মন নিয়ে তার সাথে কথা বলতে বলতে রাঙ্গুনিয়ায় কোদালা ঘাট দিয়ে কর্ণফুলী নদী পার হলাম। আমাদের গন্তব্য কোদালা হাই স্কুল। বাস থেকে বুইজ্জার দোকানে নেমে কিছুদূর হেঁটে তারপর নদী পার। নদীর একশ’ গজের মধ্যে নয়নাভিরাম স্কুল। এই অল্প সময়ের মধ্যে উপভোগ করলাম নদীর অপরূপ সৌন্দর্য। পরিষ্কার জলরাশির ওপর দিয়ে শাঁ শাঁ করে এগিয়ে চলছে নৌকা কোদালা ঘাটের দক্ষিণ প্রান্তে।
লিলুর জন্ম নিকটবর্তী চন্দ্রঘোনার দেওয়ানজী হাট নামের গ্রামে। মা-বাবা দু’জনই ইহলোক ত্যাগ করেছেন।

লিলু মাঝির চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। আমার ধারণা ছিল, তার বয়স ৫৫/৬০ তো হবেই। আর যখনি তার বয়স কতো জিজ্ঞাসা করলাম তিনি বললেন, সবে ৪০ পেরোলো। সত্যি আমি অবাক হয়েছি। মানুষের শরীরের কি এত পরিবর্তন ঘটে! আমার ধারণার সাথে বয়সের ব্যবধানটি কোনভাবে মেলেনি। ৪০ বছরের মধ্যে প্রায় ৩৬ বছর নাকি নৌকার সাথে তার সম্পর্ক। ৩৬ বছরের জীবনে ৩৪ বছরই নৌকার দাঁড় টানতে হয়েছে তাকে। লিলু মাঝি বললেন, আগে অনেক কষ্ট পেয়েছি। নৌকা চালাতে চালাতে হাঁপিয়ে উঠতাম। এখন তো ইঞ্জিনের নৌকা বেরিয়েছে। এ কারণে আগের মতো এখন আর কষ্ট করতে হয় না।

তবে বর্ষাকালে নদীতে যখন পানি ভরপুর থাকে, তখন যাত্রীরা অনেক ভয়ে থাকে। এদেরকে সাহস দিয়ে নদী পার করাতে পারলে অনেক বেশি আনন্দ লাগে। সারাদিন নৌকা চালিয়ে যখন ঘরে যাই, ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ি। কখন রাত পার হয়ে যায় হুঁশ থাকে না। কারো সাথে একটু আনন্দ, কিংবা আড্ডা মেরে সময় কাটাবো, সেটি আর হয়ে ওঠে না। তার চোখ দিয়ে অনবরত ভেসে বেড়ায় নৌকা চালিয়ে বেঁচে থাকা এক স্বপ্নময় জীবন। যে জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জুড়ে আছে আরো অনেকের স্বপ্ন।
এই কালো মানুষটি রোদেপুড়ে যতো কালোই হোক না কেন, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক আনন্দময় প্রতিচ্ছবি। হয়তো সেই আনন্দের প্রতিফলন কখনো ঘটবে না। এভাবেই লিলু মাঝিরা অন্যের মুখে হাসি-আনন্দ ফুটিয়ে পরম শান্তি লাভ করবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট