চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সংসারের জিনিসের কী মায়া !

সালমা আনজুম লতা

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ৪:১১ অপরাহ্ণ

১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একেবারে শেষের দিকে আমার ছোট আপা ইমিগ্রেন্ট ভিসা নিয়ে আমেরিকা চলে এসেছিল। দুলাভাই আরো আগেই চলে এসেছিলেন। আমার বোনও একসময় দুই বাচ্চাকে নিয়ে চলে আসবে সেটা আগে থেকেই জানতো। কিন্তু কাগজপত্রের কথা তো সঠিক বলা যায়না। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই সংসার, বাচ্চাদের স্কুল চলছিল।আমার ছোট আপা মোহাম্মদপুরে আমাদেরই বড় আপার বাসার নিচতলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকত।

যখন ভিসা হয়ে গেল তখন গোছগাছ করার পালা।সাধারণতঃ সবাই অনেক আগে থেকেই জিনিসপত্র বিক্রি করার একটা চিন্তা মাথায় রাখে।কিছু জিনিস আত্মীয়স্বজনকে দেয়। কিছু জিনিস স্মৃতি হিসেবে অনেকদিনের জন্য আপনজনের কাছে রেখে যায়। ভাবে একসময় নিয়ে যাবে।কিন্তু সেসব আর কখনোই নেয়া হয়না।কিছু জিনিস যারা এতদিন বাসার কাজে সাহায্য করেছে তাদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে যায়।

আমার ছোট আপা আমেরিকা যাওয়ার সময় কিছুই বিক্রি করেনি। করতে পারেনি। সবাই পারেও না। বলতে গেলে প্রায় সবই আত্মীয়দের দিয়ে চলে আসে। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন আমি বলেছিলাম, আমি কোনদিন বিদেশে যাবোনা। নিজে হাতে গড়া একটা সংসার ভেঙ্গে মানুষ কেন বিদেশে যায় ?

আমার নিজের সংসারের প্রতিটা জিনিসের জন্য এত মায়া ! নিজের বিছানা, আলমারি, ফ্রিজ, টিভি, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার ফেলে আমি কোনদিন কোত্থাও যাবোনা। এমনকি আমার বহুদিনের ব্যবহার করা হাঁড়ি, পাতিল, থালা, বাটি, মগ, বালতি, বেলুন, পিঁড়ির মায়াও আমি ছাড়তে পারবোনা। ছোট আপার প্রতিটা জিনিসের জন্য আমার কি যে মায়া লাগছিল।

সেই আমি নিজের বাড়িঘর ফেলে সাড়ে সাত বছর আমেরিকায়। আমি অবশ্য আমার সংসার যেমন ছিল তেমনই রেখে এসেছিলাম। এখানে এসে নতুন করে আবার সংসার সাজিয়েছিলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমেরিকায় কোনদিন স্থায়ী হবোনা। তবুও সংসার বলে কথা। সবই তো লাগে। প্রতিবার ঢাকা থেকে এটা ওটা নিয়ে আসতাম। প্রথম প্রথম না বুঝেই অনেককিছু আনতাম।

প্রতিবার আসার সময় সবধরণের মশলা, গুড়ো দুধ, তাজা চাপাতা, মুড়ি, চানাচুর, টোস্ট নিয়ে আসতাম। আমেরিকার গুড়ো দুধ আর দারুচিনি খেতেই পারতাম না।একসময় বুঝলাম এখানে সবই পাওয়া যায়। বরং আরো ফ্রেস জিনিস পাওয়া যায়।

সংসারের শুরুতে আমার ছোট ভাবী অনেক জিনিসপত্র দিয়েছিল। খাট, ড্রেসার, বালিশ, চাদর, থালা বাটি, হাঁড়িপাতিল। পরে আস্তে আস্তে আমিও কিনেছিলাম।

এবার সব ফেলে চলে যেতে হবে। যেদিন ঠিক করলাম চলে যাবো সেদিন থেকেই মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। নিজের কাপড় ছাড়া আর সবই ফেলে আসতে হবে। চারিদিকে তাকাই আর ভাবি,কত শখ করেই না এতকিছু কিনেছিলাম। আসবাব, ক্রোকারিজ, দেয়াল ঘড়ি, ইস্ত্রি, ওভেন, কিচেনের কত্ত জিনিসপত্র।

ছেলেদের অনেক কাপড়, বই খাতা, জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, ক্রিকেটের সরঞ্জাম আরো কত কি।সবচাইতে কষ্ট হচ্ছে আমি ঢাকা থেকে প্রচুর বই এনেছিলাম। সেই বই সবগুলো ফেরৎ নিতে পারবোনা। আমার পছন্দের এই বই বাচ্চারাও কোনদিন পড়বেনা। ওদের বই পড়ার সময়ও নেই। দেশে পুরোন জিনিস দেয়ার মত, নেয়ার মত বহু লোক আছে। কিন্তু এখানে কেউ নেই।

এক একবার ভাবি এই প্যানডামিক এ কত কত মানুষ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে আর আমি কিনা সামান্য সংসারের জিনিসের এত মায়া করছি ? যত কষ্টই হোক আর মায়া বাড়াবো না। সব ডোনেট করে চলে আসবো।

গতকাল থেকেই শুরু করলাম।এই বাছাবাছির পর্বটা বেশ কঠিন।কোনটা রাখবো আর কোনটা রাখবো না।সবচাইতে বেশি বিপাকে পড়েছি আমার লেখালেখির কাগজপত্র নিয়ে। যখন যেটা মাথায় আসতো লিখে রাখতাম। সেগুলো জড়ো করে দেখি প্রায় এক ব্যাগ। এই লেখালেখি তো আমার সন্তানের মত। এদের ফেলে আসি কী করে ?

ভেবেছিলাম এত ব্যস্ততার মাঝে আর লেখালেখি করবোনা। কিন্তু আমার এই কষ্টের কথা শেয়ার না করলে যে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে ।

বারবার নিজের জীবনটাকে একেবারে সাধারণ করে ফেলতে চেয়েছি। ভেবেছিলাম আর কিচ্ছু কিনবোনা। একসময় টিপ থেকে শুরু করে জুতা পর্যন্ত ম্যাচিং না হলে মন ভরতো না। আর এখন ? একজোড়া কাল জুতা আর কাল একটা ভ্যানিটি ব্যাগ হলেই চলে। মাঝে মাঝে এমনও মনে হয় আমার জুতা সেন্ডেলও কেউ যদি আমার পায়ের মাপ মত কিনে দিত বেঁচে যেতাম।

এবার দেশে এসে আমি ‘ কাশবনে ‘ থিতু হতে চাই। যেন আর কখনোই এমন করে সংসার ফেলে, আমার প্রিয় পোষা ময়নাকে ফেলে লম্বা সময়ের জন্য চলে যেতে না হয়। জানিনা ভাগ্যে কী আছে ? এরপর আমেরিকায় ছেলের কাছে বেড়াতে আসবো। একটা স্যুটকেস নিয়ে।

লেখক: সালমা আনজুম লতা; অ্যারিযোনা ,যুক্তরাষ্ট্র।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট