চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

নারীর মূল্যবোধেই পুরুষের সম্মান

ফারজানা আজিম

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ৯:০০ অপরাহ্ণ

কন্যা- জায়া- জননী- তিনটি শব্দ মিলে দাঁড়ায় একটি পবিত্র সত্ত্বার নাম, যাকে আমরা কখনো মেয়ে কখনো স্ত্রী কখনো বা মা বলে সম্বোধন করি। এরা সবাই মিলে একজন।

নারী। পবিত্র কোরআনে যার স্থান মানবকূলের মধ্যে সবার উপরে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি চিত্র দেখতে পাই? ঠিক কি অবস্থায় আছে আজ আমাদের নারী সমাজ। সম্ভবত আমরা আবার ফিরে গেছি সে জাহেলিয়াত যুগে, যখন জীবন্ত কবর দেয়া হতো নারীদের অর্থাৎ শিশু নারীদের। যারা পৃথিবীর আলো দেখতে না দেখতেই হারিয়ে যেত অন্ধকার কবরে। আমরা কি বুঝতে পারি কেন জীবন্ত কবর দিত তাদের? উত্তর হল- লজ্জা। অর্থাৎ সে যুগে নারীদের যেভাবে ব্যবহার করা হতো কোনো পিতৃরূপী পুরুষই তা মেনে নিতে পারতেন না। তাই তারা নিজ সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত অন্যের সন্তানকে ভাগে করার জন্য। কারণ তারা জানতো তাদের সন্তানও একদিন বড় হয়ে এমন অবস্থার শিকার হবে। কারণ সমাজ ব্যবস্থাটাই ছিল এমন।

শুনেছি পৃথিবীতে কিছু হারায় না ভালো বা মন্দ। হয়তো তাই আমরা আবার ফিরে এসেছি সেই জাহেলিয়া যুগে অন্যরূপে অন্যভাবে। কি লজ্জা! আজ আমরা এত সভ্যতা অর্জন করেও ঠিক সেই জায়গাতে রয়ে গেছি- ঠিক সেই অসভ্য৷ মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। আজ আমাদের সমাজে।

মূল্যেবোধে বলতে আমরা ঠিক তিন রকমের মূল্যবোধকে বুঝি। প্রথমতঃ সামাজিক মূল্যবোধ দ্বিতীয়তঃ পারিবারিক মূল্যবোধ এবং তৃতীয় ধর্মীয় মূল্যবোধ। এই তিন মূল্যবোধের অভাব আজ আমাদের সমাজে, যার জন্য প্রতিনিয়ত ঘটছে গুম খুন ও ধর্ষণের মতো মারাত্মক ঘটনা। আজ আড়াই মাসের শিশু থেকে শতবর্ষী নারী পর্যন্ত রেহাই পায় না লালসার শিকার থেকে। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা আজ বড়ই কঠিন।

আজ এই আকাশ সংস্কৃতি আমাদেরকে যেমন দিয়েছে অনেক ঠিক তেমনি কেড়ে নিয়েছে বহু কিছু। সর্বপ্রথম যে জিনিসটা কেড়ে নিয়েছে এই আকাশ সংস্কৃতি তাহলো আমাদের মুল্যবোধ। আজ আমরা হারিয়েছি আমাদের সামাজিক পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। মূল্যবোধহীন একজন মানুষ তথা সমাজ কখনো সুস্থভাবে টিকে থাকতে পারে না। তাই আজ বড়ই প্রয়োজন মূল্যবোধের চর্চা।

একটি শিশু যখন পরিবার থেকে সঠিক মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠে না, তখন সে সামাজিক মূল্যবোধ বুঝতে পারে না। আধুনিকতার নামে আজ আমরা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে হারাতে বসেছি। যেই সমাজে পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থাকে না, সে সমাজে সামাজিক মূল্যবোধও থাকে না। ঠিক তখনই শুরু হয় নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা।
আমি মনে করি কোন মানুষ কখনো জন্ম থেকে অপরাধী হয় না, বা সে অপরাধী হয়ে জন্মায় না। আমরাই তাদের অপরাধী তৈরি করি পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ থেকে দূরে রেখে। ধীরে ধীরে সেই শিশু হয়ে উঠে অপরাধী হারিয়ে যায় অন্ধকার গলিতে। নারীর প্রতি অসম্মান- অবজ্ঞা থেকে জন্ম নেয় হিংস্রতা; যা ধীরে ধীরে গ্রাস করে সমস্ত সমাজকে। তাই নারীর প্রতি যথাযথ সম্মানই দিতে পারে একটি সুস্থ সমাজ।

একজন মা-ই পারে একটি শিশুকে একজন সুযোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। তাই একজন সুযোগ্য মানুষ গড়তে নারীদের সুযোগ দিব, তাদের সম্মান করে। কথায় আছে, একজন সম্মানিতা নারীর সন্তান-ই জানে অন্য একজন নারীকে সম্মান দিতে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আমাদের জীবনে নারীর অবদানের কথা। তাদের অসম্মান করে আজ সমস্ত বিশ্ব অসম্মানিত হচ্ছে।

আসুন সব ভুলে আজ নতুন পৃথিবী গড়তে নারীকে সম্মান করতে শপথ নেই। হয়তোবা এই শুভ ইচ্ছায়ই সম্মানিত হবে আজকের পৃথিবী। আমরা বড়ই অকৃতজ্ঞ। আমরা মনে রাখি সেসব নরদের যারা বীর বেশে এসেছে কিন্তু মনে রাখি না সেসব বীরঙ্গনাদের যারা বীর হতে তাদের প্রেরণা যুগিয়েছে।
আজ পৃথিবীতে যত বড় বড় মণীষী জন্মেছেন তাদের আমরা চিনি তাদের পিতার পরিচয়ে। যে মাতা তাদের গর্ভে নিল, পালন করল, তার নাম তার পাশে সাধারণত লিখা থাকে না।
জন্ম দেওয়া আর পালন করা এক নয়। নারীরা দুটোই করে থাকে। আর সেই নারীকেই আমরা খেলার পুতুল ভাবি। আমরা যদি একটু খেয়াল করে দেখি এই পৃথিবীতে যত মহৎ সৃষ্টি তার পেছনে রয়েছে কোন না কোন মহীয়সী নারী। স্বর্ণ ও রুপার কথাই ধরুন, নারীর অঙ্গের স্পর্শে এই দুই ধাতু রূপ পায় অলংকারের।
এ জগতে যত বড় বড় জয় আর অভিযানের কথাই আমরা বলি না কেন, মা- বোন- স্ত্রীদের ত্যাগ ছাড়া সবই অসম্ভব। কোন জয়ে কত রক্ত দিল পুরুষ, তা লিখা আছে। ইতিহাসে কিন্তু কত নারী যে তার সিঁথির সিঁদুর মুছে দিল, লিখা নাই তার পাশে। তাছাড়া কত মা যে দিল তার হৃদয় উপড়ে, কত বোন দিল সেবা, সেই বীরের ইতিহাসের পাশে কেউ কি লিখেছে সে কথা!

মোট কথা, কখনও কোনও পুরুষের পক্ষে একা কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়, নারীর প্রেরণা আর শক্তি জাগানো ছাড়া। তাই আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, নারী ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই সম্ভব নয়। সব অসম্ভবকে সম্ভব করাই নারীর কাজ। আমরা নারীদের ক্রীতদাসী হিসেবেই দেখি কিন্ত সে যুগ এখন বাসি হয়ে গেছে। এ যুগে কারো হাতে কেউ বন্দি নয়। প্রতিরোধ করলেই এখন প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। যুগের ধর্ম এই, পীড়ন করলে সে পীড়ন পোহাতে হবে তাকেই।
স্বর্ণ- রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে আর নারীরা বন্দি নয়। সে আজ নিজে ক্রমশঃ প্রকাশমান। সে আজ আর আড়ালে নয়, চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শিখেছে, শিখেছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ।

হাতে চুড়ি, পায়ে নুপুর, মাথার ঘোমটা আজ সে ছিঁড়েছে, ভেঙেছে শিকল। যে ঘোমটা তাকে করেছিল লাজুক, করেছিল ভীরু, সে আবরণ ছিঁড়ে দূর করেছে সে দাসীর চিহ্ন। এতদিন যে নারী বিলিয়েছে অমৃত, প্রয়োজনে সে নারী সে অমৃত পাত্রে বিলাবে বিষ। ধৈর্য ধরো হে নারী, কারণ সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন পুরুষের সাথে তোমারও হবে জয়।

পূর্বকোণ/এস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট