বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো জঙ্গিদের সঠিক প্রক্রিয়ায় ডি-রেডিক্যালাইজেশন করে জঙ্গিবাদ থেকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে র্যাব। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে জঙ্গিদের উগ্রবাদ ধ্বংস করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে দেশের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় ৯ সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
আত্মসমর্পণকারীরা হলেন শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪), ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯), আসমা ওরফে রামিসা (১৮), মোহাম্মদ হোসেন হাসান গাজী (২৩), মো. সাইফুল্লাহ (৩৭), মো. সাইফুল ইসলাম (৩১), মো. আবদুল্লাহ আল মামুন (২৬), মো. সাইদুর রহমান (২২) ও আবদুর রহমান সোহেল (২৮)।
র্যাব সদর দপ্তরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন তারা। আত্মসমর্পণ করা জঙ্গিদের মধ্যে জেএমবি’র ছয় জন এবং আনসার আল ইসলামের তিন সদস্য রয়েছেন।
আত্মসমর্পণ করা জঙ্গিদের সম্পর্কে র্যাব জানায়, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া অবস্থায় সিলেটের তরুণ শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত জড়িয়ে পড়েছিলেন উগ্রবাদী এক সংগঠনে। পরে ডাক্তার স্ত্রী নুসরাত আলী জুহিকেও সেই জালে জড়িয়ে নেন। সংগঠনের নির্দেশে চার বছর আগে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে পরিবার থেকেও আলাদা হয়ে যান। জঙ্গিবাদের অনুসারী হওয়ার কারণে শাওন ও ডা. নুসরাতকে দীর্ঘ দিন ফেরারি জীবনযাপন করতে হয়। কিন্তু সে সবই যে ‘ভুল’ ছিল, এখন তা বুঝতে পেরেছেন তারা।
আবিদা জান্নাত আসমা ওরফে তারাদা ওরফে রামিসা (১৮) সম্পর্কে র্যাব জানায়, তিনি উগ্রবাদে আকৃষ্ট হওয়ার পর পিতা-মাতার অজান্তে ২০১৮ সালে আনসার আল ইসলামের এক সদস্যের সঙ্গে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে বিয়ে করে। ফলে শুরু হয় স্বামীর সঙ্গে আত্মগোপনের জীবন। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ায় সে আত্মগোপন থেকে ফেরারী জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে। ফলে সাংগঠনিকভাবে পরিচিত স্বজনের কাছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। শাওনের পরামর্শ অনুযায়ী সে আত্মসমর্পণের সিন্ধান্ত নেয়।
র্যাব আরও জানায়, আত্মসমর্পণ করা মোহাম্মদ হাসান (২৩) ২০১২ সালে ঢাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ শুরু করে। এ সময় সাইফুল্লাহ তাকে জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। সে সাইফুল্লার সঙ্গে জেএমবির সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যায়। কিন্তু ফেরারি জীবনের অনিশ্চয়তায় ও পারিবারিক জীবনে অশান্তির কারণে এক পর্যায়ে সে তার ভুল বুঝতে পারে। সে সাইফুল্লাহর সাথে আলোচনা করে র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরবর্তীতে সে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।
অপর জঙ্গি মো. সাইফুল্লাহ (৩৭) মাদ্রাসায় পড়াকালীণ তার সহপাঠীর মাধ্যমে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হন। সে দাওয়াতী কার্যক্রম ও অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিল। কিন্তু তার কিছু সঙ্গী গ্রেপ্তার হওয়ার পর সে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। ফেরারি জীবনের কারণে তার পারিবারিক জীবনে অশান্তি শুরু হয়। সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং এক পর্যায়ে সে তার ভুল বুঝতে পারে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং পরবর্তীতে সে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এছাড়াও আত্মসমর্পণ করা মো. সাইফুল (৩১) ২০১৩ সালে সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাস করে। ছাত্রাবস্থায় সে জেএমবিতে যোগ দেয়। সে নিজ এলাকায় ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রম চালায়। জঙ্গি হিসেবে সে এলাকায় পরিচিতি পায়। ইতোমধ্যে জঙ্গি সংগঠনের কিছু সদস্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়ায় সে আত্মগোপনে চলে যায়। তাকে দীর্ঘ দিন বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে হয়। তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এবং সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এরকম জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে। পরবর্তীতে সে র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।
জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ কখনো জঙ্গিবাদকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয় না। এজন্যই আমরা জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছি। জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে না পারলেও আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। আমরা জঙ্গি দমনে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছি। আমরা যে সব সময় কঠোর হস্তে জঙ্গি দমন করি। বিষয়টি তেমন না। আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়েও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনছি।’
অনুষ্ঠানে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘নব দিগন্তের পথে’। এ বাহিনীর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার তার স্বাগত বক্তব্যে ‘ডি-র্যাডিকালাইজেশন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম’ এর প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। আতত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে মামুনকে ফার্মেসী, সাইফুল্লাহ ও সোহেলকে গাভী, সাইদুর, হাসান ও সাইফুলকে ট্রাক্টর দিয়ে পুনর্বাসন করা হচ্ছে।
পূর্বকোণ/এএ