চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

লোকজ ঐতিহ্যের নান্দনিক বুননে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র

আদম সুরত

হৃদয় সরকার

১২ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

প্রথমেই চলচ্চিত্র নিয়ে কথার সূচনা হতে পারে। আমাদের বাংলার প্রাচীন গ্রামীণ শিল্পীরা পটে-এর মাধ্যমে একের পর এক ছবি অঙ্কিত করে একটা কাহিনী বা বিষয় উপস্থাপন করতো। চলচ্চিত্র যেনো একি ধারার, চলমান চিত্রের ধারাবাহিকতা। চলচ্চিত্রকারগণ যেনো ফ্রেমে ফ্রেমে ফুটিয়ে তোলেন তাদের দর্শন, শৈল্পিক চিন্তায় চিত্রিত করেন জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে। তেমনি একজন চলচ্চিত্রকার হলেন তারেক মাসুদ।

বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে ক্ষণজন্মা এক নক্ষত্রের নাম, তারেক মাসুদ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেয়ার জন্য যে কজন মানুষ ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি তার অন্যতম। চলচ্চিত্র নির্মানের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়কে এবং বাংলাদেশকে তুলে ধরার দায়িত্ব নিয়েছিলেন যেনো তিনি। তিনি একাধারে ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক, গীতিকার। আজকে আমরা তারেক মাসুদ-এর, ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলার অন্যতম বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস.এম.সুলতান কে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘আদম সুরত’ (ঞঐঊ ওঘঘঊজ ঝঞজঊঘএঞঐ) ; এই চলচ্চিত্রটি এবং তার চলচ্চিত্রের গানে অমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির যে রূপ প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে আমার উপলব্ধি আলোচনা করবো।

‘আদম সুরত’ বাংলাদেশী আধুনিক চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘তারেক মাসুদের’ ১৯৮৯ সালের একটি প্রামাণ্যচিত্র। সুলতানের দৈনন্দিন কর্মজীবন তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলার সংস্কৃতি এবং কৃষিচিত্র উপস্থাপনা করা হয়েছে এই প্রামাণ্যচিত্রে।

তারেক মাসুদ তাঁর চলচ্চিত্রযাত্রা গ্রন্থের শুরুর দিকে ‘আদম সুরত’ নিয়ে লিখেছেন, “ছবিটির একটা কাঠামো চিন্তা করে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। সুলতান তো গণমাধ্যম বা ক্যামেরার সামনে আসতে রাজি হতেন না। তবে শেষ পর্যন্ত যে শর্তে রাজী হলেন তা হচ্ছে, তিনি যেন ছবির প্রধান বিষয়বস্তু না হন।তিনি বলনেন, ‘আমি বরং নিমিত্ত, আমাকে উপলক্ষ্য করে আপনারা বাংলার কৃষকের ওপর ছবি বানান। আমি আপনাদের সঙ্গে ক্যাটালিস্ট হিসেবে থাকবো’। তাঁর নির্দেশনা আমাদের জন্য এ রকম পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়, আমরা সুলতানের সঙ্গে ঘুরব এবং তার সঙ্গে গ্রামীণ বাংলাকে দেখবো”। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে তরুণ এই নির্মাতা সুলতানের কথার সাথে সুর মিলিয়ে শুরু করেছিলেন তার প্রামাণ্যচিত্রটির কাজ। সুলতান যেমন প্রবাসী জীবন থেকে ফিরে নাগরিক ব্যস্ততাকে পাশকাটিয়ে সাধারণ গ্রামীণ কৃষকের জীবনকে, যারা বলতে গেলে রীতিমতো যুদ্ধ করেই উৎপন্ন করে আমাদের জন্য, তাদের জীবন ও তাদের কৃত্য, তাদের উৎসব, তাদের সংস্কৃতি তথা বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে করে নিয়েছিলেন তার চিত্রকলার বিষয়বস্তু। তাই ‘আদম সুরত’ চলচ্চিত্রটি চিত্রায়িত করতে গিয়ে উঠে এসেছে চিত্রা নদীর পাড়ের তথা বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির রূপ।

“আমেরিকায় ফিল্ম নিয়ে পড়তে যাওয়ার জন্য যে অর্থ জোগাড় করেছিলাম, সেটা দিয়েই ছবির কাজ শুরু করে দিলাম। আমার মনে হয়েছিলো, সুলতানকে নিয়ে ছবিটা বানালে একদিকে যেমন একজন বড় মাপের মানুষের ডকুমেন্টেশন হবে, ঠিক তেমনি ছবি বানাতে গিয়ে ছবি বানানোর শিক্ষাটাও হবে, স্বশিক্ষিত হওয়া যাবে”। (মাসুদ, চলচ্চিত্রযাত্রা)
চলচ্চিত্রটির শুরুতেই আমরা দেখতে পাই কিছু ছবি ও আর্কাইভাল ফুটেজের মাধ্যমে টাইটেলের পূর্বেই সুলতানের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচয় দেয়া হয়। মূলত এই চলচ্চিত্রটি জীবনীমূলক ছিলো না, বরং এক ধরনের আত্ম-কথনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে শিল্পী এস এম সুলতানের সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা এবং বাংলার সংস্কৃতি এবং কৃষি। আধুনিক চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর সকল যশ, খ্যাতি, পশ্চিমা লাইফস্টাইল, সবকিছু পেছনে ফেলে তিনি যখন তাঁর গ্রামে, তাঁর শৈশবে ফিরে এসে কৃষকদের সাথে মিশে যান, দীর্ঘদিনের এই সম্পর্ক কৃষকসমাজ কীভাবে তাঁর শিল্পাদর্শ ও জীবন দর্শনকে প্রভাবিত করেছে সেটা তুলে ধরাই ছিলো এই চলচ্চিত্রের প্রধান উদ্দেশ্য।

“ক্যামেরা ইউনিট নিয়ে অনেক দিন ধরে শিল্পীকে অনুসরন করবো, তাঁর সঙ্গে বসবাস করবো, তাঁর সঙ্গে গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়াবো,তাঁর নৈমিত্তিক জীবন তুলে ধরব”। (মাসুদ, চলচ্চিত্রযাত্রা)
শিল্পীকে অনুসরণ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা শুনি তারেক মাসুদের কণ্ঠে, “কিন্তু বিজয় সরকারের বাড়িতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হবে, সেটা আর উপলব্ধি করতে পারবেন না। এরকম করে এক ধরনের বাউলাঙ্গের চলচ্চিত্র নির্মাণে আমরা জড়িয়ে গিয়েছিলাম। সুলতানের মতো এক অসাধারণ ব্যক্তির সাথে ঘুরে বাড়াচ্ছি, বিভিন্ন লোক উৎসবে যাচ্ছি এবং বাংলাদেশকে তার চোখ দিয়ে দেখছি, নতুন করে আবিষ্কার করছি। আমরা সুলতানের আশকারায়, উসকানিতে প্রচুর অর্থ, সময় ও ফুটেজ ব্যয় করেছি। বিভিন্ন লোকজ উৎসব, যেমন- কুমিল্লার পাগলার মেলা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারি, কুষ্টিয়া থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের বিভিন্ন উৎসব, ফরিদপুরের নৌকাবাইচ, ধামরাইয়ের রথযাত্রা- যেখানেই শুনতাম লোকসংস্কৃতির কোন যজ্ঞ চলছে, সেখানেই ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয়ে যেতাম।”

আমরা সমস্ত চলচ্চিত্রটি জুড়েই দেখতে পাই চলচ্চিত্রকার ছবিগুলো সাজিয়েছেন লোক ঐতিহ্যের রঙে, চিত্রশিল্পী সুলতানের দর্শনের সাথে মিল রেখে। যদিওবা কাজের শুরুতে তারেক মাসুদ কোন লিখিত ধরাবাঁধা চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেননি, চলচ্চিত্র জীবনের শুরুর এই দ্বিতীয় কাজটি তিনি সুলতানের সাথে ঘুরে বেড়িয়ে নান্দনিক ইম্প্রোভাইজেশনের মাধ্যমে প্রামাণ্যকরণ করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ সাত বছরের ১৬মি.মি. ধারণ করা এই চলচ্চিত্রটি ধারণ করা এবং স্বাধীন সম্পাদনার পর এটি একটি সুগঠিত ও ঐতিহ্যম-িত পা-ুলিপির রূপ পেয়েছে। সেই ধারা থেকেই আমরা এর সরাসরি দৃশ্যগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি।

পরিশেষে তারেক মাসুদের ভাষ্য মতে বলা যায়, শেকড় সন্ধানী চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের যে চোখ দিয়ে গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যে রূপ দেখেছিলেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, তা তার পরবর্তী চলচ্চিত্রে ছাপ ফেলেছে। প্রসঙ্গক্রমে আলোচনা করা যেতে পারে তাঁর ‘মাটির ময়না (ঞযব পষধু নরৎফ)’ চলচ্চিত্র সমন্ধে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট