চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

মানুষ ও জীবনের গল্প ‘রক্তশালুক’

অমল বড়ুয়া 

৩০ এপ্রিল, ২০২১ | ১২:৪১ পূর্বাহ্ণ

গল্পে সমুদ্র থাকে। সমুদ্রে থাকে বিশালতা। গল্প তাই যা অনির্বচনীয় রঙে জীবনের ছবি আঁকে। শব্দের বুননে তিলে তিলে গড়ে তোলে বোধ ও মননের অনিন্দ্য আনন্দলোক। পৃথিবীর তাবৎ গল্পের আদিকর্তা মানুষ। আবার সমস্ত গল্পই মানুষকে নিয়ে। গল্প মানুষ নয়। তবে গল্প মানুষের কথা বলে। জীবনের কথা বলে। ‘রক্তশালুক’ গল্পকার হাসনাত সৌরভের তেমনি জীবন উপজীব্য এক গল্পগ্রন্থ যার পরতে পরতে জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে অনবদ্য সৃজনশীলতায়।

গল্প বলা আর গল্প শোনা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানব সমাজে তৈরী হয়েছে গল্পের আঁতুরঘর। প্রাগৈতিহাসিক মানবজাতিতে ভাষার জন্ম ও পারষ্পরিক ভাব-বিনিময়ের সাথে সাথে তৈরি হতে থাকে গল্প। অজস্র গল্প- শিকারের গল্প, বাইসন, রেইনডিয়ার, গন্ডার, ম্যামথের গল্প। আগুন খোঁজে পাওয়ার গল্প, ঝরনা, নদী, তৃণভূমি, পাহাড়, গুহা, তুষারপাত, ভূমিকম্পের গল্প। অতঃপর পাথর থেকে অস্ত্র তৈরির গল্প, নেকড়ের সাথে যুদ্ধ করার গল্প আর যুদ্ধ করে দখল ও বীরত্বের গল্প। গল্পরা তখন খোঁদিত হতো পর্বতগাত্রে, পাথরে আর গুহায় ফুটিয়ে তুলতো বিভিন্ন চিত্রকলায়। এভাবে মানুষের আদি সংস্কৃতি গল্পনির্ভর হয়ে উঠে। মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে গড়ে উঠেছে মানুষের সাথে গল্পের অবিচ্ছেদ্য সখ্যতা বিনি-সুতোর অভেদ্য বন্ধন।

প্রাচীন গ্রিসে ক্রিট দ্বীপে, সিসিলিতে চারণকবিরা অতীত শৌর্য-বীর্য আর দেবদেবীর অলৌকিকতার কাহিনী গেয়ে বেড়াত। আড়াইশ বছর আগেও আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ান জনপদে গল্পবুড়োরা গল্প-ফেরি করে বেড়াত। মানুষের সৌন্দর্যের উপলব্দি স্বতঃপ্রবৃত্ত এক বোধ ভাললাগা আর ভালবাসার পুলকে জড়ানো। মানুষের আছে শিল্পবোধ আর শিল্পসৃজনের অপূর্ব সৃষ্টিশীলতা। মানুষের এই পরিশীলিত মনন, মেধা, বোধ আর বোধিই সভ্যতার ক্রমবিকাশের দ্বারা সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে চলছে দেশ থেকে দেশান্তরে কাল থেকে কালান্তরে। আধুনিক মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষের যাপিতজীবনের পুরোটাই সমাজ কেন্দ্রিকতায় নিবদ্ধ। মানুষের গল্প তাই সমাজকে ছোঁয়। সমাজে মানুষের আবেগ, প্রেম-ভালবাসা, রাগ-অনুরাগ, কামনা-বাসনা আদিমতা গল্পে মূর্ত রূপে পরিস্ফুট হয়। ‘রক্তশালুক’র এগারটি গল্পের প্রতিটিতে সমাজজীবন ও মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না আর সুখ-দুঃখের সরল চিত্র ফুটে উঠেছে।

‘লাল পাকরি’ গল্পটিতে খেটে খাওয়া কৃষিজীবি মানুষের জীবন সংগ্রাম আর সদ্য অঙ্কুরিত বুলির দেহভল্লবে মোহিত সুযোগ-সন্ধানী সামাজিক পুরুষের আদিম কামনার নগ্ন-নখর থাবা মানবিক-শুদ্ধতার গায়ে আঁছড় কাটার যে অমানুষিক প্রবণতা তাকেই চোখের সামনে তুলে ধরেছে গল্পকার তার ঋজু বয়ানে। এতো শুধু গল্প নয়। সমাজজীবনে অহরহ ঘটমান ঘটনাবলীরই সত্যকথন। সমাজে রাগ-অভিমান আছে। চাওয়া-পাওয়ার দুস্তর ব্যবধান আছে। আছে বৈষম্য আছে ক্ষোভ। আছে অধিকারহীনতার বঞ্চনা। তাই মানুষ হয়ে উঠে প্রতিবাদী। জ্বালায়-পোড়ায় ভেঙে-চুরে তাণ্ডবে বদলে দিতে চায় নিয়মনীতি। হয়ে উঠে আত্মঘাতি। এই ঘাত-প্রতিঘাতে বদলে যায় সমাজের চিত্র। মানুষ ফিরে পায় মানবিক অধিকার। গল্পকার হাসনাত সৌরভ ‘ভিন্নতর ভাঙনে’ তুলে ধরেছে নিপীড়িত গণমানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রামের কথা। মানবসভ্যতার বিকাশ নদ-নদী কেন্দ্রিক। বহুকাল ধরে মানুষের জীবন ও জীবিকা নদীর নীল জলে আবর্তিত হয়ে আসছে। কিন্তু দুষণ আর দখলে সেই নদী কি আর জীবন ও জীবিকার ভার বহন করতে পারছে ? পুজিবাদীদের হাতে বিপন্ন পরিবেশ, জীবন ও জীবিকা।

‘বিনীত বেলুন’ নামক গল্পে নদীকেন্দ্রীক গ্রামীণ জনজীবন, সমাজ ও অর্থনৈতিক টানাপোড়নে বিপর্যস্ত নিম্নবিত্ত মানুষের কথা লিখেছে গল্পকার হাসনাত সৌরভ। গল্পকার শুধু অর্থনীতির গেঁড়াকলে নিবিষ্ট না থেকে তুলে ধরেছে মানবিক হৃদয়ের নিগূঢ় ভালবাসাকে। ভালবাসায় থাকে স্বার্থপরতা। তাই তো মানুষ তার ভালবাসার মানুষকে আগলে রেখে নিজের হৃদয়-কারায় বন্দি করে সযতনে রাখতে চায়। গড়তে চায় নিজের মতো, মনের মতো। কিন্তু স্বার্থপরতাই কি ভালবাসা ? ‘ভালবাসা নিস্কাম ও নিঃস্বার্থ’ বলেছেন যথাক্রমে গৌতম বুদ্ধ আর যীশু ক্রিস্ট। হাসনাত সৌরভ তার ‘দ্বৈতসন্ধির এজাহারনামায়’ ভালবাসার মহত্ত নিঃস্বার্থতা আর উদারতাকেই তুলে ধরেছে।

‘ভালবাসা মানে কারো মঙ্গলকামী হওয়া, কারো কল্যাণ কামনা করা, ভালবাসা মানে স্বার্থ ত্যাগ করা আর ভালবাসা মানে স্বাধীনতা’ সেই চিরন্তন বাণীই প্রতিভাত হয়েছে গল্পকারের লেখনিতে। একইভাবে ‘সলিটারি সেলের চিঠি’তে অন্ধকার কারাগারে বন্ধি কয়েদীর মুক্তির অদম্য কামনা পাঠকের মনকে আন্দোলিত করবে বৈকি। পাঠক গল্প পড়তে পড়তে সামাজিক জীবনবোধের পাশাপাশি থ্রিলারের বুনো স্বাদও পাবে ‘উপোসি জীব’ আর নাম গল্প ‘রক্তশালুক’ এ।

‘শনিবারের আসরে’ গ্রামীণ জীবনের অনবদ্য পাঠ বিমোহিত করবে পাঠককে। ‘রক্তশালুক’ গল্পগ্রন্থটি মোট এগারটি গল্প ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক সৌষ্ঠব আর প্রসঙ্গ নিয়ে পাঠকের মানসপটে জীবন আর বোধের ভাবনা জাগাবে। মর্মে মর্মে জাগাবে কল্পলোকের অনিন্দ্য অনুভব ভাললাগার পুলক। অক্ষরবৃত্ত প্রকাশন থেকে বইমেলা-২০২১ উপলক্ষে প্রকাশিত বইটি সুন্দর পরিপাটি মুদ্রণ প্রমাদ বিরহিত।  গল্পের বয়ানে গল্পকারের সবালীলতা গল্পগুলোকে সুখপাঠ্য করেছে। এটা তার প্রথম গ্রন্থ হলেও তার লেখায় পরিপক্কতা ও মুনশিয়ানা আছে।       

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট