চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস

২২ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৪০ পূর্বাহ্ণ

আজ জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে সড়ককে নিরাপদ করার লক্ষ্যে আন্দোলন করে আসছে। সড়ককে নিরাপদ করার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ২২ অক্টোবর পালিত হয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এর গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন মন্ত্রীপরিষদের সভায় ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর থেকেই নানা স্লোগানে দিনটি ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এবার ‘জীবনের আগে জীবিকা নয়, সড়ক দুর্ঘটনার আর নয়’ স্লোগানে তৃতীয় বারের মতো দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে ’জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’। সড়কদুর্ঘটনা প্রতিরোধে সাধারণ মানুষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করাই দিবসটি পালনের মূল লক্ষ।

উল্লেখ্য, ২৬ বছর আগে বান্দরবানে স্বামী ইলিয়াস কাঞ্চনের কাছে যাবার পথে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে মর্মান্তিক এক সড়কদুর্ঘটনায় নিহত হন জাহানারা কাঞ্চন। ইলিয়াস কাঞ্চন সে সময় সিনেমার শুটিংয়ে বান্দরবান অবস্থান করছিলেন। স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে দু’টি অবুঝ সন্তানকে বুকে নিয়ে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে ইলিয়াস কাঞ্চন নেমে পড়েন সড়কদুর্ঘটনা প্রতিরোধের আন্দোলনে। ‘পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়’ শ্লোগান নিয়ে গড়ে তুলেন একটি সামাজিক আন্দোলন ‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’। একইসঙ্গে প্রতিবছর ২২ অক্টোবর জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন পালন করা হয় ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’। এখন দিনটিকে সরকার ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ ঘোষণা করেছে, যাতে সড়কদুর্ঘটনার ব্যাপারে সবাই সচেতন হয় এবং প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। উল্লেখ্য, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা পূর্বাপেক্ষা বেড়েছে। সরকারও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে আশানুরূপ সাফল্য এখনো আসেনি।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির হার কিছুটা কমলেও ২০১৬ থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট অনুযায়ী এ জন্যে চালকের বেপরোয়া মনোভাবই প্রধানত দায়ী। বিভিন্ন তদন্ত ও গবেষণারিপোর্ট বলছে সড়কদুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে প্রথম কারণটি হচ্ছে চালকদের বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো। সড়কদুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের বেপরোয়া গতি। পাশাপাশি বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাট নির্মাণে ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোনের ব্যবহার, চালকদের মাদক সেবনসহ নানা কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। আবার যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতাও অনেক দুর্ঘটনার কারণ। কিন্তু এসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেই। দায়ীদের শাস্তির নজিরও তেমন নেই। ফলে প্রতিদিনই সড়কদুর্ঘটনার বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যাত্রীকল্যাণ সমিতির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে সড়কদুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন অনেকটাই মহামারী আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশে। এখন প্রতিবছরই দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির হার বাড়ছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর সড়কদুর্ঘটনা ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার হার বেড়েছে ২২ দশমিক ২ শতাংশ।

পথচারী মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বছরে সড়কদুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৪২ ভাগের বেশি পথচারী! জ্যামিতিকস হারে বেড়েছে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনাও। যা সচেতন নাগরিকদের ভাবিয়ে তুলেছে।
১৭ বছরের সড়কদুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ দেখা যায়, দেশে সবচেয়ে বেশি ৪৩ শতাংশ সড়কদুর্ঘটনা সংঘটিত হয় মহাসড়কে।

শহরাঞ্চলে সড়কদুর্ঘটনা ঘটে ২৩ শতাংশ, আঞ্চলিক মহাসড়কে ১৩ শতাংশ এবং বাকি ২১ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্ম গ্রামীণ সড়কে। আর দুর্ঘটনার ১৯ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে হয়। এসব সংঘর্ষের ৭০ শতাংশই প্রাণঘাতী। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ১৮ লাখ যানবাহন চলছে ভুয়া চালক দিয়ে। সারা দেশে প্রায় ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছে। ৬২ শতাংশ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে যথাযথ সাইন-সংকেত নেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কদুর্ঘটনা ইনস্টিটিউট (এআরআই) বলছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব দায়ী। কিন্তু মূল কারণ শণাক্তের পরও সমাধানে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেই। এখন সংশ্লিষ্টদের খামখেয়ালির সুযোগে পরিবহণ খাত অনিয়মের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রতিদিনই জ্যামিতিক হারে বাড়ছে সড়কদুর্ঘটনা। আর এর প্রধান শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

আমরা মনে করি, এ বিষয়ে আর নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। দেশস্বার্থে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।

সরকারের উচিত এমন আয়োজন নিশ্চিত করা যাতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটিই কমে আসে এবং পর্যায়ক্রমে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। মনে রাখা দরকার, ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করতে হলে নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ যানবাহন, দুর্ঘটনার পর জরুরি সেবার মানোন্নয়নের বিকল্প নাই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট