২০০৫ সালে সড়ক থেকে ৫-৬ ফুট উঁচুতে ‘মিয়া বাড়ি’ নির্মাণ করেন ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. শাহজাহান রাজু। প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬ কাঠা জায়গার উপর নির্মিত এই একতলা বাড়িটি এখন অনেকটা পরিত্যক্ত। ভবনের চারপাশের ৪ কাঠা জায়গাও পরিণত হয়েছে ডোবায়।
এর বড় কারণ হচ্ছে- প্রতি বছর পানিতে ডুবতে থাকায় মিয়া বাড়ির সামনের জানে আলম দোভাষ সড়ক কয়েক দফায় অন্তত ১৬ ফুট উঁচু করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এতে মিয়া বাড়ির ছাদ এবং সড়ক একাকার হয়ে গেছে। ছাদ থেকে হেঁটে যে কেউ মূল সড়কে চলে আসতে পারছে অবলীলায়।
জানে আলম দোভাষ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী কাদের নেওয়াজ জানান, জলাবদ্ধতা থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষা করতে গড়ে ১৬ ফুট উঁচু করতে হয়েছে সড়কটি। তবে কোনো কোনো জায়গায় ২৯ ফুট পর্যন্ত উঁচু করতে হয়েছে। এতে কিছু ঘরবাড়ি সড়কের চেয়ে নিচু হয়ে গেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।
মিয়া বাড়ির অদূরেই সৈয়দ আমান আলী পেশকার বাড়ির আব্দুল নবী জামে মসজিদ। ১৯ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডের সৈয়দ শাহ রোডের এই মসজিদটি নতুন করে নির্মাণের জন্য সম্প্রতি ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। মসজিদ ভাঙার কারণ জানতে কথা হয় এটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এস এম ফজলুল হকের সঙ্গে।
তিনি জানান, জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে গত ১৫ বছরে তিন দফায় সৈয়দ শাহ রোড ৬-৯ ফুট উঁচু করা হয়েছে। এতে মসজিদটি সড়ক থেকে অনেক নিচু হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে মসজিদের বেশিরভাগ অংশ তলিয়ে যায়। এ কারণে আগের মসজিদ ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে।
শুধু মিয়া বাড়ি বা আব্দুল নবী জামে মসজিদ নয়- নগরীর নিম্নাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড, ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ড এবং ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড ঘুরে অন্তত ২৫০ ভবনের নিচ তলা পরিত্যক্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। একই অবস্থা শুলকবহর, বহদ্দারহাট এবং চান্দগাঁও এলাকারও। সেখানেও অন্তত ১০০টি ভবনের নিচতলা পরিত্যক্ত হয়ে গেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।
এতো গেল নগরীর এক প্রান্তের কথা। এবার অন্য প্রান্তের দিকে নজর দেয়া যাক। ডবলমুরিং থানাধীন সিডিএ ১৫ নম্বর সড়কের সুলতান আল-নাহিয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নির্মাণ করা হয় ১৯৮৭ সালে। সম্প্রতি বিদ্যালয়টি ঘুরে দেখা গেছে- বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে শ্রেণিকক্ষগুলো অনেকটা নিচু। নিচতলার ছয়টি কক্ষ পরিত্যক্ত হয়ে গেছে।
২০০৫ সাল থেকে এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন আনোয়ার শাহাদাত। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে তিন-চার মাস বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়। এছাড়া বৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে পরীক্ষাও স্থগিত করতে হয় বিভিন্ন সময়। জলাবদ্ধতার কারণে পুরোনো ভবনে পাঠদানে সমস্যা হওয়ায় নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।
আগ্রাবাদ ও হালিশহর এলাকার আরও অন্তত দুই শতাধিক ভবনের নিচ তলা এখন অনেকটা পরিত্যক্ত। এসব এলাকায় স্কুল পানিতে ডুবে যায়। বন্ধ করে দিতে হয় কার্যক্রম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিবছর ডুবছে নতুন নতুন স্কুল ভবনও। যার একটি সিডিএ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোডের চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন হাতেখড়ি স্কুল এন্ড কলেজ।
এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিচ তলায় শ্রেণিকক্ষসহ মোট ২৪ কক্ষ রয়েছে। এর কোনটিই এখন ব্যবহৃত হয় না। সবগুলো কক্ষ পরিত্যক্ত। এসব কক্ষে বেঞ্চ, টেবিল, চেয়ার, বোর্ড পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এর কারণ জানতে কথা হয় প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরীর সাথে।
তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এই ভবনের নিচ তলা ও মাঠ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। স্কুল ও কলেজের অনেক ফার্নিচার নষ্ট হয়ে গেছে। জলাবদ্ধতা ও বৃষ্টির কারণে গত ২০ বছর ধরে আমাদের শিক্ষার্থীরা মাঠে খেলাধুলা করতে পারছে না এবং নিচতলার শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে পারছি না।
হাতেখড়ি স্কুল এন্ড কলেজের ঠিক বিপরীতে একটি সাদা রঙের পাঁচতলা ভবন। ভবনের পুরো উঠান পানিতে পূর্ণ। গত ১ মাস ধরে কোনো বৃষ্টি না হওয়া সত্ত্বেও এত পানি কোত্থেকে এলো তা নিয়ে কথা হয় ভবনের নিরাপত্তা কর্মী ৫৮ বছর বয়সী মো. আসাদ আলীর সঙ্গে। গত ছয় বছর ধরে এই ভবনের সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করা আসাদ আলী বলেন এই ভবনে একটি শিপিং অফিস ছিল। চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ মে মাসের দিকে পুরো ভবনটি খালি করে অফিসটি এখান থেকে চলে যায়।
চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে আসাদ আলী তার পায়ের গাম বুট দেখিয়ে বলেন, রাস্তা থেকে গাম বুট পায়ে দিয়ে অফিসে প্রবেশ করতে হয়। বৃষ্টি বা অতি জোয়ার হলে তো কথা নেই। তখন পেন্ট হাঁটুর উপর তুলে কিংবা লুঙ্গি পরে অফিসে আসতে হয়। সামান্য বৃষ্টি বা জোয়ারের পানিতে নিচতলা পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়েই অফিস ছেড়ে চলে গেছে তারা। গত ছয় মাসেও এই ভবন ভাড়া হয়নি কিংবা ভাড়া নেয়ার জন্য কাউকে আসতে দেখা যায়নি।
জলাবদ্ধতার কারণে নগরীর একের পর এক এলাকা এভাবে প্লাবিত হওয়ায় এসব এলাকার ভবনগুলোর নিচতলা পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ব্যবহার উপযোগী এসব প্রতিষ্ঠান পরিত্যক্ত হওয়ায় মালিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে কী পরিমাণ ভবন বা বাসাবাড়ি পরিত্যক্ত হয়েছে এর সঠিক কোন তথ্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বা সিডিএ’র কাছে নেই।
কেন এই জলাবদ্ধতা:
২০১৭ সালে ইউএস ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স এন্ড স্পেস এডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) আশঙ্কা করেছিল আগামী ১০০ বছরে চট্টগ্রাম পানির নিচে ডুবে যাবে। এছাড়া, পরবর্তী শতাব্দিতে হিমবাহ গললে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৪ দশমিক ১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে, দ্য ইন্টার গভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) ২০০৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের সি লেভেল প্রতি বছর ৫ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এছাড়া, প্রতিবছরই চট্টগ্রাম নগরীর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে এবং জোয়ারের উচ্চতা আগের রেকর্ড ভঙ্গ করছে। প্রথমবারের মত ২০২০ সালে আগস্টে জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন জেটি প্লাবিত হয়। যার ফলে রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের পণ্যের ক্ষতি হয়।
দ্য সেন্টার ফর এনভাইরনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস এর (সিইজিআইএস) তথ্য মতে, বন্দর নগরীর প্রায় ৬৯ শতাংশ এলাকা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রায় জোয়ারের কারণে প্লাবিত হয়। যখন জোয়ার, বৃষ্টির পানি এক হয় তখন শহরের এই ৬৯ শতাংশ যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ দশমিক ৫ মিটার পানিতে ডুবে যায়।
জানতে চাইলে জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. রিয়াজ আক্তার মল্লিক বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি চট্টগ্রামে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। প্রতি বছর, জলের স্তর উচ্চতর হচ্ছে, অন্যদিকে জলাশয়গুলো কমছে। গত কয়েক দশকে জলাশয়ের সংখ্যা কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে।
সিইজিআইএস এর তথ্য মতে, আগ্রাবাদের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ০ দশমিক ৪২ মিটার কিন্তু দৈনিক গড় উচ্চ জোয়ার কমপক্ষে ২ দশমিক ৫১ মিটার। এই এলাকায় বর্ষায় জোয়ারের সময় সর্ব্বোচ্চ পানির স্তর রেকর্ড করা হয়েছে ২ দশমিক ৭৬ মিটার। বঙ্গোপসাগরের সাথে কর্ণফুলী নদীতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২ দশমিক ৫১ মিটার উচ্চ জোয়ারের কারণে সৃষ্ট বন্যা এসব এলাকার বাসিন্দাকে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে।
জানতে চাইলে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সদ্য সাবেক পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ্ আলী বলেন, চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান করতে হলে দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধার করে খালের প্রশস্ততা বাড়াতে হবে। খালের সাথে সংযুক্ত ড্রেনগুলোতে পানি চলাচলের প্রবাহ সচল রাখতে হবে। এছাড়া, জলাধার সংরক্ষণ বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি মানুষ সচেতন না হলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি সম্ভব না।
পূর্বকোণ/পিআর