নগরীর বায়েজিদ আরেফিন নগরে এক যুগ ধরে ভাঙারির ব্যবসা করছেন কুমিল্লার যুবক মোহাম্মদ ইউনুছ। এক বছর আগেও তার দোকান ‘মায়ের দোয়া ট্রেডার্সে’ কর্মচারী ছিল ১৫ জন। তারা দিনে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করতেন ২০০-২৫০ কেজি।
তবে এখন পাল্টে গেছে ইউনুছের ভাঙারি ব্যবসার এ চিত্র। ওই দোকানে এখন কাজ করছেন ৪২ জন কর্মচারী। তারা দিনে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করছেন ৮০০-১০০০ কেজি। যার অর্ধেকের বেশি পলিথিন বর্জ্য।
শুধু মোহাম্মদ ইউনুছ নন, তার মতো ২০০ ভাঙারি বিক্রেতার দোকানে গত এক বছর ধরে তিন থেকে চার গুণ বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ হচ্ছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামে এভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ বেড়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশের সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা- ইয়ং পাওয়ার ইন সোস্যাল এ্যাকশানের (ইপসা) একটি উদ্যোগ।
এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে চসিকের ৪১টি ওয়ার্ডের নালা-নর্দমা, ডাস্টবিন, খোলা জায়গা, বাসা থেকে প্রতিদিন ২ হাজার ৮০০ জন সেবক প্লাস্টিক, পলিথিন সংগ্রহ করেন। পরে ইপসার তালিকায় থাকা ২০০ ভাঙারি বিক্রেতার কাছে বিক্রি করেন। প্রতিকেজি পলিথিনের বাজারমূল্যের সঙ্গে সেবকরা ২ টাকা এবং ভাঙারি বিক্রেতা ১ টাকা প্রণোদনা পান। কেজিপ্রতি এ আর্থিক প্রণোদনাই চট্টগ্রাম নগরীতে প্লাস্টিক, পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহে গতি এনেছে।
কেন এ উদ্যোগ :
সংশ্লিষ্টরা জানান, নগরীতে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে প্লাস্টিক, পলিথিন বর্জ্য প্রায় ২৫০ টন। অর্থনৈতিক মূল্য না থাকায় এসব বর্জ্যরে ৫৬ শতাংশই সংগ্রহ করা হয় না। অসংগৃহীত প্লাস্টিক, পলিথিন বর্জ্য পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। খাল-নদী ভরাট করে। পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করে। জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এ অবস্থায় প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গবেষণা করার উদ্যোগ নেয় ইপসা।
ইপসার গবেষণায় উঠে আসে, রিসাইকেল বাজারে ভালোমানের ব্যবহৃত সিঙ্গেল প্লাস্টিক, পলিথিনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এর পাশাপাশি পরিত্যক্ত-নষ্ট প্লাস্টিক, পলিথিন শহর থেকে সংগ্রহ করে রিসাইকেল বাজারে পৌঁছানো গেলে এগুলোও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় আসবে। এতে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে লাভবান হবে। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতাও অনেকটা কমে আসবে। পাশাপাশি নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।
এ প্রেক্ষাপটে ইউনিলিভার বাংলাদেশের কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতায় নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প গ্রহণ করে ইপসা। ২০২২ এর জুন থেকে কিছু এলাকায় এ প্রকল্পের পাইলটিং হয়। চলতি বছরের ২৪ জুন এ নিয়ে ইউনিলিভার বাংলাদেশ, চসিক এবং ইপসার মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পের অধীনে ২০২২ এর জুন থেকে ২০২৩ এর অক্টোবর পর্যন্ত ১১ হাজার ৫৪২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
যেভাবে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে :
প্রথম পর্যায়ে নগরীর বাসা-বাড়িতে সবুজ, হলুদ এবং লাল রঙের আলাদা আলাদা ড্রাম প্রদান করা হচ্ছে। সবুজ ড্রামে পচনশীল বর্জ্য, হলুদ ড্রামে অপচনশীল (প্লাস্টিক, পলিথিন) বর্জ্য এবং লাল ড্রামে ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন বর্জ্য রাখতে বাসিন্দাদের সচেতন করা হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে এলাকার ডাস্টবিন এবং তৃতীয় পর্যায়ে ময়লার ভাগাড় থেকে পচনশীল বর্জ্য, অপচনশীল বর্জ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন বর্জ্য আলাদা অলাদা সংগ্রহ করেন ইপসার তালিকাভুক্ত সেবকরা।
এরপর বাসা-বাড়ি, ডাস্টবিন এবং ময়লার ভাগাড় থেকে সংগ্রহ করা পলিথিন ইপসার তালিকাভুক্ত ভাঙারির দোকানে নিয়ে যান সেবকরা। শেষপর্যায়ে ভাঙারি বিক্রেতা এসব পলিথিন বিক্রি করেন রিসাইকেল বাজারে। মাস শেষে প্রতিকেজি পলিথিনে সেবকরা ২ টাকা এবং ভাঙারি বিক্রেতা ১ টাকা করে প্রণোদনা পান। সব লেনদেন করা হয় ব্যাংকিং চ্যানেলে। প্রতিমাসে কত কেজি পলিথিন সংগ্রহ হচ্ছে তা প্রত্যায়ন করে সিটি কর্পোরেশন।
সেবক ও ভাঙারি বিক্রেতাদের প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য সহায়তা, নিরাপত্তা সামগ্রী, সেরা বর্জ্য বাছাইকারী পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে প্রকল্পের অধীনে। এছাড়া ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ, জুমার খুতবায় প্রচারণা, স্কুল ক্যাম্পেইন, ইয়ুথ জার্নালিজমের মাধ্যমে নগরবাসীকে প্লাস্টিক, পলিথিন বর্জ্য নিয়ে সচেতন করা হচ্ছে। পুরো ব্যবস্থা স্থায়ী করতে সেবক, ভাঙারি বিক্রেতা ও রিসাইকেল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হচ্ছে।
পূর্বকোণ/আরডি