চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্প্রতিক অগ্রগতি প্রেক্ষিত চট্টগ্রাম

এস. এম.ওমর ফারুক

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:২৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের শহরে শিক্ষাবিস্তারে পৌর কর্তৃপক্ষের অবদান চিরস্মরণীয়। অবিভক্ত ভারতের চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান, জ্ঞানতাপস ব্যক্তি মৌলভী নূর আহমদ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করে উপমহাদেশে শিক্ষা সাধনায় পথিকৃৎ হয়ে আছেন। শিক্ষা জাতির সাঠিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অপরিহার্য পূর্বশর্ত-এ উপলব্ধি থেকে জাতির পিতা বঙ্গুবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর-পরই ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩৬,১৬৫টি (ছত্রিশ হাজার একশত পয়ষট্টি) প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এর মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে উৎকর্ষ সাধণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কুচক্রিদের হাতে ১৯৭৫ খ্রি. এর ১৫ আগস্ট শাহাদতবরণ না করলে হয়ত আজ থেকে চল্লিশ বছর পূর্বেই বাংলাদেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতীয়করণ করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা সম্প্রসারণ কর্মসূচি বর্তমানেও তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুসরণ করে চলেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ঝউএ’র লক্ষ্য অর্জনে এসব পদক্ষেপ কার্যকর ও ফলপ্রসূ অবদান রাখবে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক’টি হলÑ২৬ হাজারের বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৯১ হাজার শিক্ষকের চাকুরীসহ জাতিরকরণ, ৩০০টির বেশি বেসরকারি কলেজ শিক্ষক কর্মচারীর চাকুরীসহ জাতীয়করণ, নতুন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করণ (পর্যায়ক্রমে সকল প্রতিষ্ঠান করার লক্ষে), বিনামূল্যে বই বিতরণ, প্রায় ১কোটির ৩০ লাখ শিশুকে উপবৃত্তি প্রদান, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি ও ঝরে পড়া রোধকরার লক্ষ্যে স্কুল ফিডিং প্রকল্প গ্রহণ, পর্যায়ক্রমে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ, পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি জেলায় একটি কারে পাবলিক বিদ্যালয় স্থাপন, মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ ইত্যাদি।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এসব পদক্ষেপের সুফল চট্টগ্রামেও এসে পৌঁছেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কাজ দ্রুতলেেয় এগিয়ে চলেছে। চট্টগ্রাম মহানগরে সরকারের শিক্ষা কর্মসূচির বাস্তবায়নে অন্যতম অংশীদার হিসেবে বহু আগে থেকেই সুনামের সাথে কাজ করে চলেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। জ্ঞানতাপস ব্যক্তিত্ব মৌলভী নূর আহমদ প্রায় ১০০ বৎসর পূর্বে চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে নগরবাসীর শিক্ষার সূচনা করেছিলেন তা দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পল্লবিত হয়ে

আজ অনেক বড় পরিসরে অবদান রেখে চলেছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ২১টি কলেজ, ৪৭টি বিদ্যালয়, ৩৫০টি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, ৩টি নৈশ শিক্ষা কেন্দ্র, ১টি নৈশ বিদ্যালয়, ১টি পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার ইনস্টিটিউট, ১টি হোমিও প্যাথিক কলেজ, ১ টি হেলথ টেকনোলজি এন্ড ম্যাটস ইন্সটিউট এবং ১টি মিডওয়াইফারি ইন্সিটিটিউট পরিচালনা করছে। চসিক পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর পি.এস.সি পরীক্ষায় প্রায় ১৫০০ জন, জে.এস.সি পরীক্ষায় প্রায় ৮০০০ (আট হাজার) জন, এস.এস.সি পরীক্ষায় প্রায ৪৫,০০০ (পয়তাল্লিশ হাজার) জন এবং প্রায় ৮০০০ (আট হাজার) জন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সাফল্যের সাথে পাস করে বের হচ্ছে। ইতোমধ্যে চসিক পরিচালিত ৪টি কলেজে ¯œাতক কোর্স এবং ২টি কলেজে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।
বর্তমান সরকার ঝউএ বা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে যে বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করছেন তার সহায়ক হিসেবে চট্টগ্রাম মহানগরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এ শিক্ষা-সম্প্রসারণ প্রয়াস চট্টগ্রামবাসীর জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ঝউএ র অন্যতম লক্ষ্য সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা (এসডিজি-৪) নিশ্চিতকরণ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে সেটি ঝউএ’র লক্ষ্য অর্জনে এতদঅঞ্চলে সহায়ক ভূমিকা যেমন পালন করবে তেমনি সরকারের মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে অগ্রগতি সাধন করতে পারবে।
এখন প্রশ্ন হল মানসম্মত শিক্ষা কি? ব্রাসেলস ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ঊফঁপধঃরড়হ ওহঃবৎহধঃরড়হ (ঊও) বলছে ধনী-দরিদ্র, লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনগোষ্ঠীকে সমমানের শিক্ষা নিশ্চিত করাই হল মানসম্মত শিক্ষা। ই আই (ঊও) তাদের গবেষণাপত্রে মানসম্মত শিক্ষার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে টিউশন ফি এবং অন্যান্য পরোক্ষ খরচপাতিকে (ঞঁঃরড়হ ভববং ধহফ ঃযব রহফরৎবপঃ পড়ংঃং ড়ভ বফঁপধঃরড়হ) চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে পর্যায়ক্রমে সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেওয়ার কথা ভাবছেন। অন্যান্য পরোক্ষ খরচপাতি শূন্যের কোটায় আনার জন্য কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। শিক্ষকদের ক্লাস পাঠদানে মনোযাগী করার জন্য বেতন ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করছেন। শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচি জোরদারসহ পর্যায়ক্রমে সকল শিক্ষা উপকরণ বিনামূল্যে প্রদানের চিন্তাভাবনা করছেন।
বর্তমান সরকার যদি গণতন্ত্রকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সক্ষম হন এবং সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন এর লাগাম টেনে ধরে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে বলা যায় আগামী ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ হয়ে যাবে। বলাবাহুল্য পৃথিবীর অনেক দেশ বহু আগে থেকেই সর্বস্তরের শিক্ষা বিনামূল্যে রাষ্ট্রীয় খরচেই বিতরণ কারে আসছে। বিশ^ব্যাপী শিক্ষা মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তাই ঊও তাদের গবেষণাপত্রে সকল দেশেই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সকল নাগরিকের বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে সকল রাষ্ট্রের জন্য সুপারিশ করছে।
প্রত্যাশা করতে চাই, চট্টগ্রাম অঞ্চলে যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন, ভাবছেন তারা যেন ঝউএ’র লক্ষ্যমাত্রা এবং বর্তমান সরকারের শিক্ষা কর্মসূচিগুলো গভীরভারে পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের অবদানটুকু সমন্বয় করেন। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে যারা এখনো বাণিজ্যিক চিন্তা ভাবনা করছেন তারা নিশ্চয় বর্তমান সময়ে ইউরোপের বহু দেশে ¯œাতক এবং ¯œাতোকোত্তর শিক্ষা বিনাখরচে বিতরণের সংবাদ অবগত হবেন।
সবশেষে বলতে চাই, চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-এর ভূমিকা আরো শাণিত হউক। মানসম্মত শিক্ষা বিতরণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এতদঅঞ্চলে দৃষ্টান্ত হউক, চসিক এর প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দেশ প্রেমিক মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে আধুনিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হউক।
লেখক : অধ্যক্ষ, প্রাবন্ধিক।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কায়সার নিলুফার কলেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট