চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

পূর্বকোণ : স্পর্ধিত তারুণ্যের স্বপ্ন

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

সংবাদপত্র জগতের অন্যতম জনপ্রিয় খবরের কাগজ চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণ। চট্টগ্রামের মানুষের খবর নিয়ে সমাজের খবর নিয়ে, সংস্কৃতির খবর নিয়ে, আঞ্চলিকতার খবর নিয়ে, পত্রিকাটির নিরন্তর যাত্রার ৩৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের এই অঞ্চলের কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক, পাঠক লেখক সচেতন মানুষের, খেটে খাওয়া মানুষের ভালোবাসা নিয়ে পত্রিকাটি সমৃদ্ধ, বিকশিত, উচ্ছ্বসিত। জাতীয় খবরে সমৃদ্ধ, আন্তর্জাতিক খবরে সম্পৃক্ত, খবরের কাগজটি পাঠক মানুষের চেতনার কাছে, মনের কাছে পৌঁছে যাওয়ার, কাছাকাছি থাকার কৌশল অর্জন করেছে দারুণভাবে, গ্রহণযোগ্যতার সাথে, যোগ্যতার সাথে। খবরের মান, সমকালীন গ্রহণযোগ্যতা, আকার আঙ্গিক এবং বস্তুনিষ্ঠতা দিয়ে খবরের কাগজটি কালোত্তীর্ণ। এভাবেই পথ চলে কাগজটি ৩৪ বছর কাল অতিক্রম করেছে। পৌঁছে গেছে পাঠকের চিন্তায়, চেতনায়, মননে।

১৯৮৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটির জন্ম। চট্টগ্রামের প্রথিতযশা চট্টল সমাজ সংস্কারক, সামাজিক উদ্যোক্তা মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী কাগজটির জন্মদাতা। আধুনিক চট্টগ্রাম গড়ার মানস নিয়ে, তাঁর চিন্তা, চেতনা ও মননশীলতার প্রতীক হয়ে পত্রিকাটি যাত্রা শুরু করে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের নান্দনিক উর্বর এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সামাজিকতাকে ধারণ করে পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত জননন্দিত সাংবাদিক কে জি মোস্তফা।

৩৪ বছর আগের কথা। অদম্য পথচলার মানস নিয়ে পত্রিকাটি মুদ্রণ সংকলনের যাত্রা শুরু করে। ১৯৮৯ সাল থেকে স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। ১৯৯৪ সালেই কাগজটি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মূল্যায়নে আঞ্চলিক পত্রিকাসমূহের শীর্ষে উঠে আসে সেরা আঞ্চলিক পত্রিকার মর্যাদা। এভাবে নিরন্তর আপোষহীন পথচলায় পত্রিকাটি সমৃদ্ধ হয়েছে। এর কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে অনেক লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, প্রতিবেদক এবং সমাজের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব।
২০১৫ সাল থেকে কাগজটি অনলাইন সংস্করণে অদম্য যাত্রা শুরু করে। দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রামের বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করা, পাঠকের হৃদয় ছোঁয়া কাগজটি আঞ্চলিকতা ছাপিয়ে জাতীয় পর্যায়ে তার পরিচিতিকে পৌঁছে দেয়। ২০১৭ সালে সম্পাদক স্থপতি তসলিম উদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর ডা. ম রমিজউদ্দিন চৌধুরী কাগজটি সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। ইতিমধ্যেই কাগজটির প্রচলন সংখ্যা ৬২ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
২০১৯ সালের মে মাস থেকেই কাগজটির মূল প্রিন্ট সংস্করণের পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টার অনলাইন নিউজ পোর্টাল যাত্রা শুরু হয়। অত্যন্ত সঠিক এবং কালজয়ী স্লোগান ‘সঠিক সংবাদ সবার আগে’ ধারণ করে পত্রিকাটি অদম্য পথ বেয়ে চলেছে। বর্তমানের প্রকাশক জসিম উদ্দিন চৌধুরী এবং সম্পাদক ডা. ম রমিজ উদ্দিন চৌধুরীর আন্তরিকতা এবং সর্বোচ্চ নিবেদনে কাগজটি জনমানসে পাঠকের মগজে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।
এ প্রচেষ্টায় একদল নিষ্ঠাবান কর্মীবাহিনী, লেখকগোষ্ঠী, সংবাদ সংগ্রাহক, প্রতিবেদক নিরন্তর নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের সকলের যৌথ প্রচেষ্টার স্রোতধারা আজকের জনপ্রিয় কাগজ দৈনিক পূর্বকোণ। দুর্বার পথচলার ৩৫ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে কাগজটি। অভিনন্দন কাগজটিকে, এর সাথে যুক্ত শুরু থেকে অদ্যাবধি সকলকে।

সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা কাগজটির পাতা সংখ্যা, নান্দনিকতা এবং সুন্দর ঝকঝকে মুদ্রণ কার্যক্রম আকর্ষণীয়। কাগজটির জন্মলগ্নে চট্টগ্রাম শহরের নাগরিক সংখ্যা ছিল ২০ থেকে ২৫ লাখ। বিকল্প কাগজের সংখ্যা খুব একটা ছিল না। পাঠকের চাহিদা পূরণে জাতীয় পত্রিকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। সেই সময়ের বিচ্ছিন্ন পাঠকদের একীভূত করে পাঠমনস্ক করার দায়িত্বটি এই কাগজ পালন করছে। এজন্য কাগজটি এতদঞ্চলের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। আমার বলতে ভালো লাগে যে, এই পত্রিকা দিয়েই আমার লেখালেখির শুরু। মনে আছে, প্রথম লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘বিপর্যস্ত বিশ্বপরিবেশ- প্রাসঙ্গিক ভাবনা।’ অত্যন্ত পুলকিত হয়েছিলাম লেখাটি যখন ছাপা হয়েছিল। কিছুদিন বিরতি দিয়ে লেখাটি তিনবার ছাপা হয়েছিল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এখনও লেখাটির কর্তিত অংশ আমার সংগ্রহে আছে। নতুন লেখক হিসেবে কাগজটির কর্তৃপক্ষ আমাকে সম্মানীও দিয়েছিল। প্রাপ্ত সম্মানী আমাকে উৎসাহিত করেছিল, করেছিল আবেগাপ্লুত। লেখাটি প্রকাশের স্মৃতি মনে হলে পুলক অনুভব করি। অজানা পুলকে আনন্দিত হই। শিহরণ জাগে মনে ও মননে।
কাগজটি প্রতিশ্রুতিশীল। নতুনত্বকে ধারণ করে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। তাই এটি সমসাময়িক, আধুনিক। আর এ জন্যই এটি তারুণ্যের ও মননকেও জয় করে চলেছে নিরন্তর।

জাতীয়, আন্তর্জাতিক খবরের সাথে চট্টগ্রামের খবর অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে এখানে প্রকাশিত হয়। যথার্থ গুরুত্ব বহন করে পত্রিকাটিতে সাহিত্যের পাতা, সংস্কৃতির পাতা, কবিতা ও গল্পের পাতা। এছাড়াও খেলাধুলা, বিনোদন শিল্পকলা, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষাপাতা কাগজটিকে সমৃদ্ধ করে। অলংকরণের নান্দনিকতায় পূর্ণ থাকে পত্রিকাটির আঙ্গিক। পত্রিকাটির ফিচার পর্ব, সপ্তাহের বিভিন্ন দিন বা মাসের উল্লেখযোগ্য পাতা, নাগরদোলা, টুকিটাকি, রমণীয়, বিভিন্ন মাত্রায় নান্দনিক। শহর থেকে দূরের কাহিনীগুলো, কৃষির পাতা, ভ্রমণের পাতা, রাশিফল প্রতিটি অঙ্গ অংশই আকর্ষণীয়। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় পত্রিকাটির সম্পাদকীয় পাতা।
পরিবেশ নিয়ে পত্রিকাটিতে সমৃদ্ধ লেখা ছাপা হয়। চট্টগ্রামের পরিবেশবোদ্ধা এবং পরিবেশ চর্চাকারীদের অনেকেই এখানে লেখেন বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন স্তরের। পরিবেশের অন্যতম উপাদান চট্টগ্রামের নান্দনিক পাহাড়, খাল-নালা, বাতাসের দূষণ, আবর্জনা ও পয়োনিষ্কাশন বিড়ম্বনা, শহরের জলাবদ্ধতা, ঋতুভিত্তিক পাহাড় ধ্বস পত্রিকাটিতে জীবন্ত উপস্থাপিত হয়।

চট্টগ্রামের অন্যতম নান্দনিকতা এর নদী প্রকৃতি। নদী কাহিনী, নদী উপাখ্যান । হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য, নদীর কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন এবং এর সংরক্ষণের সামাজিক সচেতনতা তৈরি এবং বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ কাগজের ভূমিকা অনন্য। নদীর উৎপত্তি এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশ এই পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিভিন্ন সময়ে ছাপা হয়ে ইতিহাসের, ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে কাগজটি। হয়েছে নন্দিত।
চট্টগ্রাম তথা দেশের প্রাণপ্রবাহ, অর্থনীতির মেরুদন্ড, জীবন্ত কিংবদন্তি কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন বাস্তুতান্ত্রিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পারিপার্শ্বিক প্রতিবেদনগুলো এই কাগজটিকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি এই কাগজের মাধ্যমে প্রাণপ্রিয় কর্ণফুলী নদী জাতীয় চেতনাকে নাড়িয়েছে দারুণভাবে। এভাবেই এই কাগজটির সাথে কর্ণফুলীর এবং কর্ণফুলী সাথে এই কাগজটির আত্মিক যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার আর্থিক, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক মূল্য অনেক বেশি।
চট্টগ্রাম প্রাচ্যের রানীনগরী। মহানগরীতে প্রায় ৭০ লাখ অধিবাসী। পত্রিকাটির প্রারম্ভিক সময়গুলোতে অর্থাৎ আশির দশকে মহানগরী জনসংখ্যা ছিল ২৫ লাখের মতো। দিন গেছে, বছর গেছে, লুসাই পাহাড়ের কর্ণফুলী অনেক জলকে বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দিয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর আকার-আকৃতি বেড়েছে, আয়তন বেড়েছে, জনসংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে মানুষের জীবনে আধুনিকতা, নান্দনিকতা, আঞ্চলিকতার বিস্তৃতি বিকাশ। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে সবকিছুর সাথেই।

পত্রিকাটি এসব কিছুর সাথেই তাল দিয়ে নিজেকেও সমৃদ্ধ করেছে। সৃষ্টি করেছে অনেক প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, লেখক সাংবাদিক, শিল্পী প্রমুখ। এই পত্রিকাটির নিবিড় এবং আত্মিক সম্পর্ক শুরু থেকেই বিরাজমান ছিল পাঠক, ভক্ত, অনুরক্তদের সাথে। যা সবসময়ই অব্যাহত ভাবে বৃদ্ধি পেযেছে। এ জন্যও চট্টগ্রামের মানুষ পত্রিকাটিকে মননে ধারণ করে, লালন করে।
কাগজটির বিস্তৃতি, বিকাশ এবং অন্যান্য যুগোপযোগী উন্নয়ন আমাদের প্রত্যাশা। নিরন্তর কালজয়ী পথচলায় এই অঞ্চল, এই দেশ, এই দেশের সামাজিকতা, সাংস্কৃতিকতা, পারিপার্শ্বিকতা সমৃদ্ধ হবে এই কাগজটির মাধ্যমে। এই কাগজটি বর্তমানকে ইতিহাসের কাছে পৌঁছে দেবে, ইতিহাসের আলোকে বর্তমানের পথ চলায় আলো ছড়াবে, এটি আমাদের প্রত্যাশা। কাগজটির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে অন্তরময় অভিনন্দন। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের নিরন্তর পথচলায় কাগজটি অদম্য পথযাত্রী হয়ে কালোত্তীর্ণ হবে, এ প্রত্যাশা করছি। কাগজটির সার্বিক সমৃদ্ধি, বিকাশ, বিস্তৃতি কামনা করি।

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, কর্ণফুলী গবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট