চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আগরতলা মামলা ঃ মিথ ও বাস্তবতা

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

নাওজিশ মাহমুদ

৬ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:২৭ পূর্বাহ্ণ

ভবিষ্যতে যাতে এই ৬ দফা বা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন প্রশ্নে কেউ কথা বলতে না পারে, সে জন্য সেনাবাহিনী বিমানবহিনী ও নৌবাহিনীর বাঙালি সদস্য, উর্ধ্বতন বেসামরিক কর্মকর্তা এবং সংখালঘু রাজনৈতিক নেতাকে জড়িত করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রধান আসামী করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেকে। মামলার নামকরণ করা হয় রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার। এর বাহিরে প্রায় ৩৪ জনকে ৬ জানুয়ারী ১৯৬৮ সালে গ্রেফতার করে মামলার আসামী করা হয়।

অভিযুক্তদের মধ্যে সিএসপি অফিসার ছিলেন ৩ জন রুহুল কুদ্দুস আহমেদ ফজলুর রহমান ও খান সামসুর রহমান (যারা ৬ দফা রচনার মূল ভূমিকা রেখেছিলেন)। রাজনীতিবিদ ছিলেন দুজন। দুজনেই চট্টগ্রামের ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ঃ বিভূতিভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী ও বিধান কৃষ্ণ সেন। আর ছিলেন নৌবাহিনীর কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। আর বাকীরা ছিলেন প্রতিরক্ষা বাহিনীর ক্যাপ্টেন পদমর্যাদা ও তাঁর নীচের অফিসার। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, অভিযুক্তরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল।
এই মামলায় সরকার বহুবিধ লক্ষ্যকে সামনে রেখে সুবিধা নিতে চেয়েছে। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথ থেকে সরিয়ে দেয়া। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বাঙালি সদস্যদের নিয়োগ বন্ধ করা করা। তৃতীয়ত, বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদোন্নতিসহ আমলাতন্ত্রে বাঙালির শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনঠাসা ও অধিক হারে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা। পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র প্রমাণ করে ভারতকে বিশে^র কাছে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং সর্বশেষে বাঙালিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া।

আগরতলা মামলা বাঙালির মননে এক গভীর প্রতিক্রিয়া হয়। বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে তাঁদের অন্তরের অন্তঃস্থলে লালিত স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নের নায়ক হিসেবে স্থান দিয়ে দেয়। পাকিস্তানের শাসকদের বিপরীতে একজন বাঙালি নেতার উত্থানকে স্বাগত জানায়। শেখ মুজিবের বীরত্বকে তাঁরা ধারণ করে আগরতলার মামলা ও পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শক্তি পায়। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনী, বেসামারিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সংখ্যালঘুসহ সর্বস্তরের বাঙালিদের শেখ মুজিবের পিছনে একত্রিত হওয়ার সুযোগ করে দেয় এই আগরতলা মামলা। যুব সমাজ আগরতলা মামলার কাহিনী পড়ে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে।
ভাষা আেেন্দালনকে কেন্দ্র করে বাঙালির মনে যে আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের মাধ্যমে তার প্রতিফলন হয়েছিল। কিন্তু নেতাদের ব্যর্থতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে বাঙালি আবার ঘুরে দাঁড়াবার আকাক্সক্ষার জন্ম দেয়। এই আগরতলা মামলার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে প্রতিরোধের শক্তি নতুন মাত্রা পায়। পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী বার বার বাঙালির আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান এবং ভূমিকা রাখতে গিয়ে আরো বেশী বাঙালিকে উস্কে দেয়। আওয়ামীলীগের জেলা পর্যায়ের নেতাদের একটি অংশ শেখ মুজিবের প্রতি কিছুটা সংশয় থাকলেও এই মামলার পরে তাঁদের সেই সংশয় দূর হয়ে যায়। নিউক্লিয়াসের প্রভাবে ছাত্রলীগ দ্রুত সংগঠিত হয়ে উঠে। বাঙালি মধ্যবিত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মধ্য দিয়ে তাঁদের স্বপ্ন পূরণের অপূর্ব সুযোগ মনে করে তাঁকে অকুন্ঠ সমর্থন দেয়। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী এবং সামরিক কর্তপক্ষ বাঙালিকে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়। তখন বাঙালির সামনে আর কোন বিকল্প থাকে না। হয় রুখে দাঁড়াও নতুবা চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাও। বাঙালি রুখে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নেয়।

ছাত্রদের এগার দফা ভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে প্রধান শ্লোগান হয়ে উঠে শেখ মুজিবের মুক্তি চাই। আগরতলাকে কেন্দ্র করে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গতি পায়। ৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধে তাসখন্দ চুক্তির পর পশ্চিম পাকিস্তানে যে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ দানা বেঁধেছিল তা ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে মাওলানা ভাসানী প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করার ফলে আন্দোলন নতুন গতি পায়। পাকিস্তানের উভয় অংশে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যদিও ভিন্ন, আইয়ুবের ক্ষমতা ছাড়ার ব্যাপারে কারো দ্বিমত ছিল না। পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গদি হারাবার শংকায় নতুন চাল দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের আলোচনার জন্য আহ্বান জানান। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা স্পষ্ট করে বলে দেয় শেখ মুজিবকে ছাড়া আলোচনা অর্থহীন। তখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব প্যারোলে (অস্থায়ীভাবে) বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে রাজি হয়। শেখ মুজিবও এ প্রস্তাবে প্রথমে রাজি হয়ে যান। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ সরাসরি বিরোধিতা করেন। বেগম মুজিবকে জানিয়ে আসেন যদি বঙ্গবন্ধু প্যারোলে প্রেসিডেন্টের বৈঠকে যোগ দেন, তা হলে তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করবেন। বেগম মুজিবও বঙ্গবন্ধুকে এম এ আজিজের বার্তা পৌঁছে দেয়ার সাথে সাথে নিজের বক্তব্যও জানিয়ে দেন, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বৈঠকে যোগ দিলে তার (বেগম মুজিবের) মরামুখ দেখতে হবে। বঙ্গবন্ধু দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। নিঃশর্ত মুক্তি ছাড়া তিনি বৈঠকে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে গড়িমসি করতে থাকে। আন্দোলনও আরো বেগবান হয়ে উঠে। এর মধ্যে সার্জেন্ট জহিরুল হককে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয়। এর প্রতিবাদে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে জঙ্গি মিছিল আগরতলার মামলার জন্য গঠিত ট্রাইবুন্যালে বিচারপতিদের বিচারালয়ে আক্রমণ করে।

জনতার আক্রমণে বিচারপতি এস এ রহমান পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। জনতা বিচারালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাকিস্তান সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জনাব তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। এই ভাবে আগরতলা মামলা বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের রাজনীতির বাঁক বদলের (ঞঁৎহরহম ঢ়ড়রহঃ) প্রধান উপকরণ হিসেবে কাজ করে। বঙ্গবন্ধু বিজয়ী বীরের মত প্রেসিডেন্টের আহূত বৈঠকে যোগ দেন, যিনি কয়েকদিন পূর্বেই ছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার আসামী। বৈঠকে সকল বিরোধীদলের নেতারা একমত হতে ব্যর্থ হন। তবে অবাধ নির্বাচন, এক ব্যাক্তির এক ভোট এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রশ্নে ঐকমত্য হয়। নির্বাচিত সদস্যরা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন এবং আইয়ুব খান আর নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না, এই ঘোষণা দেন। বৈঠকের কয়েকদিন পরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে। আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন। ইয়াহিয়া খান ’৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বাহবা কুড়ালেও, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির কাছে পরাজিত হয়ে লজ্জাজনক ভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন।

তবে, এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় আগরতলা মামলার প্রতিক্রিয়ায় উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, ৭০ এর নির্বাচন এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি হাজার বছরের গ্লানিকে মুছে ফেলে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দেয়, যার অধিকাংশ বাঙালি। (সমাপ্ত)

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট