চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মহান ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

মোঃ মোরশেদুল আলম

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। প্রথম পর্যায়ে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে এটি রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে অন্যান্য ভাষাসংগ্রামীদের মতো বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা বা অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আলোচ্য প্রবন্ধে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়ে বিশ্লেষণের প্রয়াস চালানো হয়েছে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল মুসলিম লীগ উত্থাপিত সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিত্ত্ব। পূর্বপাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীগত সাদৃশ্য তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে একটি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে। বাঙালিরা সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সকল প্রকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে উঠে শিল্পকারখানা এবং সম্পদের পাহাড়, আর পূর্ববাংলাকে বানানো হয় তার কাঁচামালের যোগানদাতা। পূর্ববাংলার জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী শাসকদের উপনিবেশসুলভ আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এ অঞ্চলের মানুষের দ্রুতই মোহভঙ্গ ঘটতে থাকে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের পরিবর্তে বাঙালিরা আরেকটি উপনিবেশবাদের কবলে পতিত হয়। যাকে আমরা ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ’ বলে অভিহিত করতে পারি। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতাসহ নানাবিধ বৈষম্যের কারণে পূর্বপাকিস্তানে এ বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রবল আকার ধারণ করে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এ অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলায় শুরু হয় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন ও সংগ্রাম। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলন ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম বহিঃপ্রকাশ। বাংলা ভাষার উপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও মুসলিম লীগ চক্রের আক্রমণ ছিল মূলত বাঙালি জাতির আবহমান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, হাজার বছরের ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের উপর নগ্ন আঘাত। এর ফলস্বরূপ যে রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়, তা বাঙালি জাতির মধ্যে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের মুখোশ উন্মোচিত হতে থাকে।
পূর্ববাংলার যুবসমাজ তখন থেকেই নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য সোচ্চার হয়। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলের একটি কক্ষে প্রথম বৈঠকটি হয়। সে বৈঠকে উপস্থিত হাতেগোনা কয়েকজন নেতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সরকারি ফরম, ডাকটিকিট, মুদ্রা, রেলের টিকিট প্রভৃতিতে কেবল ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহার করা হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিষয় তালিকা থেকে এবং নৌ ও অন্যান্য বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষায় বাংলাকে ইচ্ছাকৃতভাবেই বাদ দেওয়া হয়। তাছাড়া পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুকে নির্ধারণ করা হলে পূর্ববাংলার শিক্ষিত মহলে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। একটি পরিসংখ্যানে পরিদৃষ্ট হয় যে, সমগ্র পাকিস্তানের ৫৪.৬ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী এবং মাত্র ৭.২ শতাংশ মানুষ উর্দুভাষী। পাকিস্তানের সমগ্র অঞ্চলের মোট সাতটি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা অর্ধেকেরও বেশি মানুষের মাতৃভাষা এবং অন্য ছয়টি ভাষায় অর্ধেকেরও কম মানুষ কথা বলে। অতএব যে কোন বিচারে, যুক্তির মাপকাঠিতে এবং বাস্তব পরিস্থিতিতে একমাত্র বাংলাভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার অধিকার রাখত। কিন্তু সমাজ ও রাজনীতির মৌলিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকমহল ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির উপর নগ্নভাবে আক্রমণ শুরু করে।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ নামে একটি প্রগতিশীল যুবসংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এ সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন পাঠ করেছিলেন। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পূর্বপাকিস্তান কর্মীসম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্বপাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ এ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে মাতৃভাষায় বিনা খরচে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পাওয়ার মৌলিক অধিকারের দাবি উচ্চারিত হয়েছিল। জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনেরও দাবি জানানো হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এ সম্মেলনকে তাদের স্বার্থবিরোধী মনে করে হামলা চালিয়ে ভ-ুল করার অপচেষ্টা করে।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দিদের মধ্যে একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার জন্য পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে বিনাবিচারে বঙ্গবন্ধুকে এক নাগাড়ে দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে বন্দি রাখা হয়।

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ পূর্বপাকিস্তানে ছাত্রধর্মঘটের পরিকল্পনা করে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ১০ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে সভা আহ্বান করা হয়। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়কসহ অনেকেই যখন পাকিস্তান সরকারের সাথে আপোস করতে চেয়েছিল, তখনই বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছিল: ‘সরকার কি আপোসের প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে, তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে।’ ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ সিদ্ধান্তকে সেদিন অলি আহাদ, তোয়াহা, শামসুল হক প্রমুখ সমর্থন জানিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসংগ্রামী অলি আহাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌঁছতেন, তাহলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতো না।’ হরতাল পালনকালে সেক্রেটারিয়েটের সামনে থেকে সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অলি আহাদ, শামসুল হক, শওকত প্রমুখ গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু তখনও কারাগারে বন্দি ছিলেন। মিছিলসহ সারা শহর প্রদক্ষিণ করে পরবর্তী নির্দেশনার জন্য সবাই বেলতলায় জড়ো হয়। শামসুল হক চৌধুরী, গোলাম মাওলা, আব্দুস সামাদ আজাদের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতালের প্রতি বঙ্গবন্ধু সমর্থন জানিয়েছেন বলে জেলখানা থেকে খবর পাঠান। একটি উপদেশও বঙ্গবন্ধু সেদিন তাঁদের মাধ্যমে দিয়েছিলেন। মিছিল করে আইনসভা ঘেরাও করা এবং বাংলা ভাষার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করার জন্য তিনি বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আরো একটি খবর পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি এবং মহিউদ্দিন সাহেব সকল রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে জেলখানায় আমরণ অনশন করবেন।

বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এভাবে জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘…আমাকে যখন জেল কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করল অনশন ধর্মঘট না করতে, তখন আমি বলেছিলাম, ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনা বিচারে বন্দি রেখেছেন। কোনো অন্যায়ও করি নাই। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব।’ জেলখানায় অনশনে যাওয়া পূর্বে বঙ্গবন্ধু তাঁর মনের অবস্থা এভাবে ব্যক্ত করেন, ‘…একদিন মরতেই হবে। অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যদি মরতে পারি, সে মরাতেও শান্তি আছে।’ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ এ ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ‘না’ ‘না’ বলে এর প্রতিবাদ করে। নুরুল আমিন সরকার ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং মিছিল ও জনসমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে এবং ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দেয়। পুলিশ এক পর্যায়ে মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ অনেকে শহিদ হন। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বাঙালি জাতিই তাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ফেব্রুয়ারি গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে উর্দু এবং বাংলা উভয় ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির জীবন উৎসর্গের দিন ২১ ফেব্রুয়ারির এ শহিদ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘভুক্ত সকল স্বাধীন দেশ যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১-এর চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটাতে সাহায্য করেছিল। এটি ছিল বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। বাঙালি জাতির স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে এ ভাষাআন্দোলন পরবর্তী আন্দোলনসমূহ সফলভাবে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। এভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ববাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার যে স্ফুরণ ঘটায় তা আর থেমে থাকেনি; বরং পর্যায়ক্রমে আরো বিকশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও যুদ্ধের বদৌলতে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

মোঃ মোরশেদুল আলম সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট