চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

বায়ুদূষণ ও নির্বোধ বিকলাঙ্গ জাতি-প্রসঙ্গে

মিলফার জান্নাত

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ভয়াবহ বায়ুদূষণের কারণে নির্বোধ বিকলাঙ্গ জাতিতে পরিণত হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বায়ুদূষণের কারণে প্রায় প্রত্যেকেই নানারকম শারীরিক ও মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্টভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইন্সটিটিউটের মতে বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যায়। উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের কারণে শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ এবং মানুষিক বুদ্ধিমত্তা অর্থাৎ নির্বোধ শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে যাবে। দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রতিবছর পৃথিবীর বসবাসযোগ্য শহরগুলোর তালিকা প্রকাশ করে থাকে এবং দুর্ভাগ্যবশত গত তিন বছরে ঢাকা পৃথিবীর বসবাসযোগ্য তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এই ছয় বছরের ঢাকা শহরের বায়ুর মান পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এই সময়ে ঢাকার বায়ু সবসময় আদর্শ বায়ুমান এর চেয়ে চার থেকে ছয়গুণ বেশি ছিল। বায়ুমান খারাপ করার জন্য মূলত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা দায়ী, যার আকার ২.৫ মাইক্রন। এই অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা আমারা খালি চোখে দেখতে পাই না, এটি এত ক্ষুদ্র যে আমাদের মাথার চুলের তুলনায় এটি ২০ থেকে ৩০ গুণ ছোট (চুলের ব্যাস ৫০ থেকে ৭০ মাইক্রন)। এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

বর্তমানে চট্টগ্রামের বায়ুদূষণের যে চিত্র আমরা দেখতে পাই তা হল, শহরের ভেতরে যেমন বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প চলছে; আরেক দিকে শহরের চারপাশে শিল্প-কারখানাগুলোর ক্রমবর্ধমান দূষণও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শহরের বায়ুদূষণের পাঁচটি কারণগুলোর মধ্যে সবার আগে চলে আসে চারপাশে ইটভাটাগুলো। তাই ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামের বায়ুদুষণের মাত্রা কোন অংশে কম নয়।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ এক গবেষণায় দেখা যায় যে, গত ৬ বছরে (২০১৩-২০১৮) বায়ু দূষকগুলোর মধ্যে বিশেষ করে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পার্টিকুলার ম্যাটার (চগ২.৫ এবং চগ১০) এর পরিমাণ তুলনামূলক বেড়ে চলেছে। এ সময়ের শীতকালে বায়ুদূষণের মাত্রা জাতীয় আদর্শ বায়ুমানের ১১.৮০ গুণ বেশি ছিল এবং বর্ষাকালে আদর্শ বায়ুমানের প্রায় ২ গুণ বেশি ছিল। উল্লেখ্য যে, বর্ষাকালে বায়ুদূষণ বছরের অন্যান্য সময় থেকে কম থাকে। বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর এক গবেষণায় দেখা যায় যে, গত ১৩ মাসে (নভেম্বর ২০১৮ থেকে নভেম্বর ২০১৯) ঢাকার মানুষ মাত্র ২% (৯ দিন) সময় ভালো বায়ুসেবন করেছে এবং ৪৮% (১৮৮ দিন) মধ্যম থেকে সতর্কতামূলক দূষিত বায়ু সেবন করেছে, ২৮% (১০৭ দিন) অস্বাস্থ্যকর বায়ু, ২১% (৮২ দিন) খুবই অস্বাস্থ্যকর বায়ু এবং ১% (৫ দিন) মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর সেবন করেছে। ২০১৯ সালে বায়ুদূষণের পরিমাণ ২০১৮ সাল হতে গড়ে প্রায় ২০% বেড়েছে। চট্টগ্রাম নিয়ে এধরনের গবেষণা না হলেও চট্টগ্রামের মানুষ বর্ষাকালে হয়তো হাতে গোনা কয়েকটি দিন নিরাপদ বায়ু সেবন করার সুযোগ পায়। বাকি সময়টা দুষিত বায়ু সেবন করে।

এই সব দূষকের কারণে মানুষ ফুসফুসের ক্যান্সার, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, যক্ষ্মা, কিডনির রোগ, উচ্চরক্তচাপ, জন্মগত ত্রুটি, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব, হার্ট অ্যাটাক, যকৃত সমস্যা, গর্ভবতী মায়েদের উপর প্রভাব, চর্মরোগ ও নিউমোনিয়ার মত নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
বায়ুদূষণের ফলে শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ইটেরভাটা, অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও আবর্জনা পোড়ানোসহ নানা কারণে এ অবস্থার তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বায়ুমান গবেষকরা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এআইএলইউ বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরেরর সাথে যৌথ একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা, সড়কের ধূলা, যানবাহন এবং বায়োগ্যাস পোড়ানোকে দায়ী করে তারা।

এর থেকে বাঁচতে হলে, চট্টগ্রামের আশপাশের ইটভাটা ক্রমন্বয়ে সরিয়ে ফেলতে হবে। চট্টগ্রামের ভেতরের কেমিকেল গুদাম ও কারখানাগুলো শহরের বাইরে স্থানান্তর করতে হবে। প্রাইভেট কারে চাপ কমানোর পাশাপাশি গণপরিবহনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বায়ুদূষণ কমানোর মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ করতে পারলে জাতীয় স্বাস্থ্য অর্থনীতির ওপর চাপ কমানো যাবে। নগরের জলাশয়গুলি সংরক্ষণ ও পরিষ্কার করতে হবে। পরিসেবার অবকাঠামো তৈরি, সম্প্রসারণ ও মেরামত করার সময় খননকৃত মাটি ও অন্যান্য সামগ্রী রাস্তায় ফেলে না রেখে দ্রুত সরিয়ে নেয়া এবং দ্রুত রাস্তা মেরামত করা। এ কাজে ব্যর্থ হলে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। শিশু এবং প্রবীণবান্ধব যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। ধূলাদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনসমূহ বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে তাদের উপর অর্পিত আইনানুগ দায়িত্ব আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতার সাথে পালন করতে হবে। রাস্তাঘাট ও ফুটপাত নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করতে হবে। ধূলাসৃষ্টি করে এমন কোন সামগ্রী (বালু, মাটি, ইট, পাথর) বহনের সময় সঠিকভাবে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে। ধূলাদূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধিও জন্য সরকার ও বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম এবং সচেতন মহলের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট